কোন দেশের আবেগীয় ইস্যুতে আঘাত করে সে দেশের কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহনের মানসিকতা হিংস্রতার নামান্তর---
রাজু আহমেদ, কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক।
ভারতে বাংলাদেশ নিয়ে কোন কোন গুজব চলছে, সেখানে উসকানির মাত্রা কোন স্কেলে বইছে কিংবা বাংলাদেশের পতাকার অবস্থান কোথায়- সেসব দিয়ে আমাদের আচরণ নির্মিত না হোক। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে ইন্ডিয়ার পতাকার অবমাননা যেন কোনভাবেই না হয়। কোনো দেশের পতাকার অবমাননা জাতি হিসেবে আমাদেরকে বড় করে না্। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশমুখের ফুটপাতে কোন দেশের পতাকা আঁকানো, পতাকা পোড়ানো- এসব বিবেকের সুস্থতার বহিঃপ্রকাশ নয়। শেখ সা’দীর সেই বিখ্যাত 'উত্তম ও অধম' কবিতায়, “কুকুরের কাজ কুকুর করেছে/কামড় দিয়েছে পায়, তা বলে কুকুরে কামড়ানো কিরে/মানুষের শোভা পায়?”- চরণদ্বয় যেন আমাদের জীবনাচারের সংবিধান হয়ে ওঠে। কিংবা পল্লীকবি জসিমউদ্দীনের লেখা বহুল পঠিত বিখ্যাত 'প্রতিদান' কবিতার, “যে মুখে সে কহে নিঠুরিয়া বাণী, আমি লয়ে সখি, তারি মুখখানি, কত ঠাঁই হতে কত কী যে আনি, সাজাই নিরন্তর/আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর্।’’ চরণ চারটি পারস্পারিক বন্ধুত্ব রক্ষার সূত্র হোক।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিক সুতায় গাঁথা। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সাথে ভারতীয়দের নাম ও ত্যাগ বাঙালির মনে কৃতজ্ঞতাচিত্তে খোদিত আছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর ভারতের ক্ষমতার সিংহাসনে নরেন্দ্র দামোদার দাস মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপীর উত্থানের পর শুধু বাংলাদেশ নয় বরং প্রত্যেকটি প্রতিবেশি রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রের জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। কারো কারো সাথে চূড়ান্ত বৈরিতা চলছে। চীন এবং পাকিস্তানের সাথে ভারতের সম্পর্ক সর্বদাই বিপরীতমুখী। কিন্তু বাংলাদেশ, নেপাল, ভূটান কিংবা মালদ্বীপের সাথে যে দহরম মহরম সম্পর্ক ছিল তা এখন ইতিহাসের সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে। আফগানিস্তানের শাসকদল এবং শ্রীলঙ্কার ক্ষমতাশীনদের সাথে ভারতের সম্পর্ক কাগজে কলমে! যে ছেলেটি বলে ক্লাসের সব ছাত্ররা তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে সেই ছেলেটির মধ্যে যে সকল গুরুতর সমস্যা আছে তা আবিষ্কার করা উচিত। ভারত সর্বদা অন্যের অপরাধ বিচার করেছে। কখনোই নিজেকে মূল্যায়নের জন্য সম্পর্কের নিরপেক্ষ আয়নায় দাঁড় করায়নি। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক স্থাপন না করে স্বার্থে জন্য রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে ক্ষমতার কিংবা কোন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে ভারত যে ঐতিহাসিক ভুল করেছে তা মূল্যায়ণ হতে আরও কয়েক বছর লাগবে। এখন সীমানার চারপাশে ভারত বিরোধিতার আলামত প্রকাশ হতে শুরু করেছে। সীমানায় এখন ভারতের কোন বন্ধু নাই; যে শত্রু না সেও ভারতের শুভাকঙ্ক্ষী নয়।
বিজেপী সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডাই ছিল উগ্রবাদী হিন্দুত্ববাদ প্রতিপাদন করা এবং ভোটের রাজনীতিতে একচেটিয়াভাবে ক্ষমতায় থাকা। ভারতের সীমানার মধ্যে এ ধ্বংসখেলায় মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকার সাময়িক সফল হলেও প্রায় সব বন্ধুদের ছায়া হারিয়েছে। বিশ্ববাসী এগিয়ে চলছে। ধর্মীয়বিশ্বাস দিয়ে মানুষ মাপার বাটখারা কখনোই সার্বজনীন হয়নি। ফলাফলে ধর্মকে আশ্রয়-প্রশ্রয় করে, যুজু দেখিয়ে যারা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা করেছে তারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। কেননা ধর্মান্ধতা ও উগ্রতা সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে দীর্ঘস্থায়ী স্কেলে আশ্রয় পায়নি। একথা অনস্বীকার্য যে, বিভিন্নভাবে বাংলাদেশ ভারতের বাণিজ্য নির্ভর। বাংলাদেশও ভারতের বৃহত্তর পরিমন্ডলের লাভজনক বাজার। আত্মিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সম্পর্কের বেড়াজালে দু’দেশের জনগণ গভীর সম্পর্কে জড়িত। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব যখন হুমকির মুখে, বাংলাদেশ নিয়ে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা প্রচারে যখন কোন দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জড়িত কিংবা কোনো দেশ যখন অন্য দেশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য শত্রুতা ঘোষণা করে- তখন সে দেশের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। ইতোমধ্যেই এদেশে ইন্ডিয়া বয়কটের চেতনা প্রবল হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে বিকল্প বাজার খোঁজার চেষ্টা চলছে। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার এমন তিক্ততার সম্পর্ক সৃষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিষয়ক ভারতের পররাষ্ট্রনীতির একচোখা মনোভাব সিংহভাগ দায়ী। অধুনা সময়ে সার্বভৌম শক্তিধর কোন দেশ অন্যকোন দেশের প্রশ্নাতীত আনুগত্য দেখাবে তা কল্পনাতীত ব্যাপার। সবাই তো লেন্দুপ দর্জি হতে পারবে না!
ভারতে যাই হোক, ভারত যাই করুক- সে দেশের জাতীয় সংগীত, জাতীয় পতাকার অবমাননা কিংবা সাধারণ জনগণের সাথে শত্রুতা পোষণের নির্বুদ্ধিতা যাতে আমরা না করি। উগ্রবাদীদের সংখ্যা সর্বত্রই সামান্য। যারা ভালো, যারা সভ্য ও শিক্ষিত তারা সত্য সম্পর্কে অবগত। ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের অভ্যন্তরে দ্বি-মত সৃষ্টি হয়েছে। সচেতন ভারতবাসী বিজেপীর ফাঁদে কিংবা কতিপয় প্রচারমাধ্যমের মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় নিজেদেরকে জড়িত করেনি বরং তীব্র প্রতিবাদ করছে। আমরাও যাতে আমাদের অবস্থান থেকে প্রজ্ঞা প্রকাশ করি। কোন দেশের আবেগীয় ইস্যুতে আঘাত করে সে দেশের কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহনের মানসিকতা হিংস্রতার নামান্তর। ভারতের সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নাই, আমাদের শত্রুতা শাসকদলের বাংলাদেশ বিরোধী কু-নীতির বিরুদ্ধে। আহ্বান জানাবো এবং আশা করবো, ভারত যাতে অচিরেই সত্য জেনে তারপর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মন্তব্য করে। কোলকাতায় বাংলাদেশের পতাকা অবমাননার দায়ে তিনজন উগ্রবাদী গ্রেফতার হয়েছে, আগরতলায় বাংলাদেশের উপহাইকমিশন আক্রমনের ঘটনায় দায়ীদের গ্রেফতার ও বরখাস্ত করা হয়েছে- এগুলো সেখানকার রাজ্য সরকারের শুভ উদ্যোগ। অন্যায় ও উগ্রতার বিরুদ্ধে তাদের এই অবস্থান অবিচল থাকুক। সম্পর্ক আবার পূর্বেকার পাটাতনে ফিরে আসুক- তবে শুদ্ধ হয়ে।
বাংলাদেশেও যদি ভারতের পতাকার অবমাননা হয় তবে দোষী ও দায়ীদের গ্রেফতার করতে হবে। যে হিন্দু সংখ্যালঘুকে নির্যাতনের বরাত দিয়ে ভারতে গুজব ও উসকানির তুলকালাম চলছে তা আদতে বাংলাদেশে ঘটছেই না। তবে বিচ্ছিন্ন কিছু দুর্ঘটনা যে ঘটনি না অস্বীকারের সুযোগ নাই। সরকারকে কঠোর হস্তে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ উগ্রতাকেও দমন করতে হবে। যে যেখানে যতটুকু দোষী সেটুকুর শাস্তি নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে। মিথ্যা প্রচরণা ছড়িয়ে আতঙ্কসৃষ্টিকারীদের কিংবা অন্য কোন স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যকারীদের শনাক্ত করে আইনের কাছে সোপর্দ করতে হবে। উগ্রতা- সেটা যে পক্ষের দ্বারাই হোক তা- প্রত্যাখ্যাত। বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ ইতোপূর্বে যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে তা প্রশংসনীয়। এবার জাতীয় ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনের দ্বারা সে শান্তি ও সহবস্থানের পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। সভ্য জগতে এগিয়ে আক্রমন করা ক্ষমাহীন উগ্রতার শামিল। বরং আক্রান্ত হওয়ার পরে প্রতিরোধ গড়ে তুললে সৃষ্টিকর্তার থেকেও অনুগ্রহ পাওয়া যায়। মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য বাড়ে। ক্রিমিয়া ইস্যুতে সবাই ইউক্রেনের পক্ষে। ইসলামের প্রাথমিক যুগের সারিয়াহ ও যুদ্ধের ইতিহাস আমাদেরকে আক্রমন নয় বরং প্রতিরোধ শেখায়।
ভারত বিষয়ে যাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কোন প্যানিক সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তথা মন্দির-মসজিদ-গীর্জা এবং প্যাগোডায় সচেতনামূলক প্রচারণা বাড়াতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে দেশাত্মবোধের দীক্ষা দিতে হবে। নিজের সম্মান রক্ষা করা যেমন জরুরি, অন্যের সম্মান নষ্ট না করা তার চেয়েও বেশি জরুরি। সম্পর্ক নষ্টের মধ্যে কৃতিত্ব নাই বরং কৃতিত্ব সম্পর্ক রক্ষায়। তবে সচেতন থাকতে হবে যাতে সম্পর্কের সেতু সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে নির্মিত হয়। কেউ আমাদের নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং আমরাও সে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা অপপ্রচার চালাচ্ছি- এটা সমাধানের কাঙ্ক্ষিত পথ-পদ্ধতি নয়। ভারত ভুল পথে চলছে- এটা অনুধাবন করতে তাদের সময় লাগবে কিন্তু আমরা যাতে ভুলের ফাঁদে পা দিয়ে বিবাদ না বাড়াই- সেটুকু সবর ও সচেতনতা গোটা জাতির থেকে আকাঙ্ক্ষিত। এই দেশটি হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবার। কারো সামান্যতম অধিকারও যাতে হরণ না হয় সেজন্য জাতীয় ঐকমত্য জরুরি। আশা নয় বিশ্বাস- বাংলাদেশ পথ হারাবে না।
বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা, পতাকার মান বাঁচাতে কিংবা মানচিত্রকে সমুন্নত রাখতে আমাদের ইস্পাত দৃঢ় ঐক্য আবশ্যক। প্রস্তুত রাখতে হবে রক্ত ও জীবন। বাংলাদেশী এবং ভারতীয় সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক অটুট থাকতে যা যা করণীয় তা আমাদের করতে হবে। কিন্তু ভারতের আধিপত্যকামী নীতির বিরুদ্ধে এর সাথে সাথে সোচ্চারও থাকতে হবে। তাদের কোন অন্যায়ের প্রতিরোধে কেউ যাতে সহিংসতার পথ না ধরে- সেটা রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের শাহ আবুদল করিমের, “আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম/গ্রামের নওজোয়ায়ন হিন্দু মুসলান/মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম।’’- এমন মানবিকতার বাংলাদেশ যাতে আমাদের চিন্তা-চেতনাতে থাকে তা নিশ্চিত করতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মেলাতে হবে। ভারতের উগ্রপন্থীরা চাচ্ছে সোনার বাংলাদেশকে শ্মশানে পরিণত করতে। বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চলছে দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত। আমরা সর্বদাই যেন মনুষ্যত্ব ও মানবিকতার পক্ষে থেকে দেশকে ভালোবাসি। দেশ ও জাতির শত্রুপক্ষ তাদের অপচেষ্টায় যাতে সফল হতে না পারে সেজন্য আমাদের সকলের সজাগ থাকা জরুরি। আমাদের মধ্যে জাতীয়তা বোধ জাগলে, সামষ্টিক একতা থাকলে শত্রুর কোন চক্রান্তে আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে পারবে না। আমরা সবাই সম্মিলিত ভাবে উচ্চারণ করবো, “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’’ এবং বিশ্বাস ও কাজে তথা সার্বিকভাবে দেশপ্রেমের বোধ হৃদয়ে ধারণ ও লালন করবো- এই প্রত্যাশায় দ্বীপ্ত হোক শপথ।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন