সবার ভুল শুধরে দিলাম, সবাই এগিয়ে গেল কিন্তু আমি কোথায় ?
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক। |
প্রতিদিন একঝাঁপি অভিযোগ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার আসরে বসি। সেখানে প্রধান উপদেষ্টার ত্রুটি থেকে শুরু করে বাসার হেল্পিং হ্যান্ডের দোষ পর্যন্ত তীব্রভাবে আছে। বউ যেহেতু অবলা তাকে দু'টো বেশি কথা শোনানোই যায়! স্বামীর নামে পরের কাছে নালিশ করলে সহানুভূতিও পাওয়া যায়! নিন্দায় আমলা-পুলিশ, নায়ক-গায়ক কিংবা কুলি-মজুর কেউ বাদ যাচ্ছে না। যাকে নিয়ে ভেবেছি, যাকে ঘিরে বলেছি কিংবা যাকে নিয়ে থেকেছি- সবাই ভুলে ভরা। অতি আশ্চর্যজনক যে, সেই তালিকায় আমি নাই। যেনো আমার কোন দোষ নাই! আমরা দু'টো চোখ, একটি মস্তিষ্ক এবং মন আমার কোন ভুল খুঁজে পায়নি! বড় বড় লোকের ভুল ধরেছি এবং কাল্পনিক দণ্ড দিয়েছি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লোকের খুঁত ধরেছি এবং খোঁচা মেরেছি কিন্তু আমার কোন ত্রুটি পাইনি এবং আত্ম কৈফিয়তও জাগ্রত হয়নি। প্রশ্ন : আমার ভুল নাই? উত্তর : ভুলের অভাব নাই। অন্যরা দেখে, কেবল আমি দেখি না।
সবার ভুল শুধরে দিলাম, সবাই এগিয়ে গেল কিন্তু আমি কোথায়? সবার নামে নালিশ দিলাম, সবার বিচার হলো আর আমি একলা হয়ে পালিয়ে থাকলাম! এভাবে মানুষ হবো? পৃথিবী যদি বহুদূর এগিয়ে যায় আর আমি পিছিয়ে থাকি দূর-দূরান্তে তবে পৃথিবীবাসী একদিন আমায় ভুলে যাবে। সবার সাথে চলতে হলে, সবার সাথে কথা বলতে হলে অন্যের দোষ দেখার আগে নিজের দোষগুলো, অপরাধ-অন্যায়গুলো বোল্ড করে দেখতে হবে। আমিও যে ভুল করি, আমিও যে সবকিছু জানি না সেটা যদি স্বীকার না করি তবে আমার শুদ্ধ হওয়ার সাধ্য হবে না। আলোদের মিছিলে আমি ঠাঁই হবো না। আত্মশুদ্ধির আলোকে শুদ্ধ সমাজ গঠনে আমার অংশীদারত্ব থাকবে না।
আমি না বদলালে আমার পৃথিবীটা বদলাবে না। দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। সবাই শুধরে যাচ্ছে অথচ আমি আঁকড়ে থাকলাম ভুল, বেঠিকের পক্ষে দাঁড় করালাম যুক্তি এবং সেটার স্বপক্ষে আয়োজন করলাম তর্কসভা- অন্যকেউ নয়; আমিই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সিস্টেম সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে- এতে কোন লাভ হবে না যদি মানুষগুলো, মানুষের চরিত্র-স্বভাব না বদলায়। কঠোর আইন দিয়ে দমন করা যায় কিন্তু নির্মূল করা যায় না। ভুল করা অপরাধ নয় কিন্তু ভুল বুঝতে পারার পর সেটা স্বীকার না করা বড় ধরণের অপরাধ। ভুল করার মধ্য দিয়ে দেশ-দুনিয়ার উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়নি কিন্তু ভুল হচ্ছে জেনেোও সেটা লুকোছাপা করে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর প্রবণতাতেই আমাদেরকে হাজার বছর পিছিয়ে রেখেছে। অন্যের কাঁধে দোষ চাপানোর স্বভাব আমাদের দীর্ঘকালের!
নিজেকে পরিশোধিত করতে হবে। সবাই শুদ্ধ হোক এবং আমি যেমন আছি তেমন থাকি- এই বোধ নয় বরং আমি শুদ্ধ হবো এবং অন্যরা যে যা করে করুক- এই প্রত্যয় মানুষকে বড় করে তোলে। নিজে শুদ্ধ হয়ে অন্যকেও সাবধান করা যায়। প্রত্যেকেই যদি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়, অন্যের দোষ না খুঁজে যদি নিজের দোষ ধরে এবং শোধন করে তবে এই দেশের রীতিনীতি শুদ্ধ হতে বেশিদিন সময় লাগবে না। দেশকে মানুষের দেশ রাখার জন্য স্ব স্ব ক্ষেত্রকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। আমি যে পরিবারের কর্তা সে পরিবারকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। আমি যে অফিসের বস সে অফিসে শুদ্ধতা জারি রাখতে হবে এবং আমি যে সমাজ-সংগঠনের নেতা সেখানে অন্যায়-অপরাধ প্রশ্রয় দেওয়া হবে না মর্মে অঙ্গীকার থাকতে হবে। এভাবেই একটি দেশ ও জাতি বদলায়। জাতিকে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে।
আমি যদি নিজেই নিজের বিচারক হতে পারি, আমার বোধ-বিবেক যদি আমার পরিচালক হয় কিংবা আমি যদি সত্য ও সততার সঙ্গে থাকি তবে এই সমাজ বদলাবে। নিজে অন্যায় করবো না এবং কোন অন্যায়কে পারতঃসাধ্য প্রশ্রয় দেবো না- এই শপথে নিজেদের ভাগ্য এবং দেশের ভবিষ্যত বদলে ফেলতে পারি। সুযোগ বারবার আসে না। রাষ্ট্র গঠনের যে অপরিমেয় সম্ভবানা তৈরি হয়েছে তা ফলপ্রসূ করতে প্রত্যেককে ব্যক্তিগত লোভ-মোহের উর্ধ্বে অবস্থান করতে হবে। হাতে হাত রেখে নতুন সমাজ গড়তে হবে।
আমার ভেতরটা যদি শুদ্ধ হয় তবে বাহির শুদ্ধ ও ঋদ্ধ হতে বাধ্য। বিবেকের আয়নায় আত্মকৈফিয়তে শুনানি থাকতে হবে। কী করছি এবং কী করা উচিত?- এই বোধ বিবেকের মধ্যে ধারণ করতে হবে। আমি আমার কর্ম ও কথার বিচারক হলে কেউ আমাকে বিপথে পরিচালিত করতে পারবে না। তখন ধর্ম সঠিক পথ দেখাবে। রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন শৃঙ্খলা শেখাবে। বড়দের কাছে নত হতে এবং ছোটদের স্নেহ করতে কখনোই যেন আমার মধ্যে কার্পণ্য না আসে। ভালোর সাথে লেগে থাকা এবং মন্দ থেকে বেঁচে থাকার বোধ যাতে জীবনের সকল দিনগুলোতে থাকে। দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ। পাল্টান এবং পাল্টে দিন।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন