এক বৃষ্টির বিকেলে স্প্যানিশ পেইন্টার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা ইসাবেল হারগুয়েরা দিল্লিতে একটি বইয়ের দোকানে আটকা পড়েছিলেন। সময় কাটানোর জন্য বইপত্র নাড়াচাড়ার ফাঁকে লাল মলাটের একটি বইয়ের প্রচ্ছদে তার দৃষ্টি আটকে যায়। একজন নারী একটি মহাশূন্য যান চালাচ্ছে দেখে তিনি তাত্ক্ষণিকভাবে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন এবং বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন, এই অসাধারণ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিকে তিনি চলচিত্রে রূপান্তর করবেন। বইটি ছিল ১৯০৫ সালে প্রকাশিত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের লেখা ‘সুলতানাস ড্রিম!’ সুলতানার স্বপ্নে এই মাতৃতান্ত্রিক জগিট নারীদের নিয়ন্ত্রিত এবং পুরুষ প্রকৃতপক্ষে গৃহবন্দি।
নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তির উন্নয়নের মধ্য দিয়ে নারীরা কর্মঘণ্টা কমিয়ে এনেছে, সময় বের করে নিয়েছে বিনোদন ও অবসর যাপনের। একই সঙ্গে তারা বহুযুগের পর্দাপ্রথা বিলোপসহ পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে বড় রকমের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। গত বছর রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ অবলম্বনে চলচ্চিত্রটির নির্মাণকাজ শেষ করেছেন ইসাবেল হারগুয়েরা।
রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর জন্ম নেওয়া এই মহীয়সী নারী পেয়েছিলেন মাত্র ৫২ বছরের জীবন।
সেই সংক্ষিপ্ত জীবনের অবসানও ঘটেছিল আরেক ৯ ডিসেম্বর ১৯৩২ সালে। শুরুটা ছিল সেকালের আর দশটা সাধারণ বাঙালি নারীর মতোই অন্তঃপুরে ধর্মীয় শিক্ষা, বিয়ে এবং ঘরকন্নার ভেতর দিয়ে গতানুগতিক পার্থিব পথচলার পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু রোকেয়া এই নিয়তি নির্ধারিত পরিণতিকে পাল্টে দিতে পেরেছিলেন। তার অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং তীব্র জ্ঞান পিপাসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সমাজের পশ্চাৎপদ, অবহেলিত, নিগৃহীত এবং সীমাহীন বৈষম্যের শিকার মেয়েদের জন্য কিছু একটা করার অন্তর্গত তাগিদ।
রাষ্ট্র বা সমাজে তো দূরের কথা, যখন নিজের সংসারে বা ব্যক্তি পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর কোনো ভূমিকা ছিল না, তখনই রোকেয়া বুঝেছিলেন নারীর মুক্তির জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। তিনি নিজেকে কিভাবে প্রস্তুত করেছিলেন, সে কাহিনি সম্ভবত সবারই জানা। অনুজ্জ্বল মোমবাতির যে শিখা তিনি নিজের জন্য জ্বালিয়েছিলেন, তা ক্রমেই সহস্র আলোর মশালে রূপান্তরিত হয়ে শুধু নারীদেরই নয়, পুরো দেশ ও জাতিকে আলোকিত করেছে।
আলো দিয়ে আলো জ্বালানোর এই কাজটি মোটেই সহজসাধ্য ছিল না। তবে তা কতটা কঠিন ছিল, বর্তমান কালের স্কুল বা কলেজে পড়া শিক্ষার্থীরা তা কল্পনাও করতে পারবে না।
১৯০৯ সালে মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। পাড়া-প্রতিবেশী তো বটেই, নিজের পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের তীব্র বিরোধিতার মুখে স্কুলটি বন্ধ করে দিতে হয়। আজীবন সংগ্রামী রোকেয়া হার মেনে লক্ষ্য থেকে সরে যাননি। ১৯১১ সালে কলকাতায় আটজন ছাত্রী নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। বেগম রোকেয়ার শিক্ষা সম্পর্কিত ভাবনার পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের নানামুখী কর্মকাণ্ড বিশেষ করে মুসলমান নারীদের শিক্ষাদীক্ষা, কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়নসহ সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রেখেছিল, তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। বৃহত্তর বাংলায় নারীদের শিক্ষা ও চূড়ান্ত বিচারে তাদের চিন্তা-চেতনা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সুদীর্ঘ সংগ্রাম, সেই সংগ্রামে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন রোকেয়া।
নারীর মুক্তিসংগ্রামকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে উন্নীত করার লক্ষ্য অর্জনে তিনি নিরলসভাবে গল্প, উপন্যাস ও কল্পকাহিনিসহ সৃজনশীল লেখালেখি চালিয়ে গেছেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এসব রচনা নারীদের শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি মুক্তবুদ্ধির চর্চায় উৎসাহী এবং চিন্তা-চেতনায় সমৃদ্ধ করে তুলবে। তার লেখা প্রবন্ধ-নিবন্ধে যেমন নারীশিক্ষা, নারীপ্রগতিসহ সমাজের নানা অসংগতি ও উন্নয়ন ভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে, তেমনি বক্তৃতা-বিবৃতিতেও তিনি নারীশিক্ষার গুরুত্ব দ্ব্যর্থহীনভাবে তুলে ধরেছেন। ১৯২৬ সালে বেঙ্গল উইমেন্স এডুকেশনাল কনফারেন্সে বক্তব্য প্রদানের সময় ধর্মের ধুয়া তুলে নারীদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করার কঠোর নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘নারীশিক্ষার বিরোধীরা বলে নারীরা শিক্ষিত হলে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে যাবে! ধিক্কার জানাই...তারা নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করেও ইসলামের মূল নীতির বিরুদ্ধাচরণ করে। ইসলামে শিক্ষার সমান অধিকার দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া পুরুষরা যদি শিক্ষিত হয়ে বিপথে না যায়, তাহলে নারীরাই বা বিপথে যাবে কেন!’
পুরুষশাসিত সমাজে ২০০ বছর ধরেই কিছু মৌলবাদী সমাজপতি নারীশিক্ষার বিরোধিতা করে আসছেন। রোকেয়া একবার তার একটি লেখায় সূক্ষ্ম শ্লেষের সঙ্গে লিখেছেন, ‘আমি কারসিয়াং ও মধুপুরে বেড়াইয়া সুন্দর, সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি। উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগরের তীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের ও বিভিন্ন আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি। আর পঁচিশ বছর ধরিয়া সমাজ সেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিশাপ কুড়াইয়াছি।’ নারীকে সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা, সংসারে পদানত রাখা এবং শিক্ষা অর্জনে বিরত রাখার মধ্য দিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধিতার ক্ষেত্রে বিগত শতকের মৌলবাদীদের উৎসাহের কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু একবিংশ শতকে যখন খোদ রোকেয়ার জন্মস্থানে তারই নামে প্রতিষ্ঠিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়ার ভাস্কর্যে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়ালে আঁকা রোকেয়ার প্রতিকৃতিতে কালি মাখিয়ে দেওয়া হয়, তখন বুঝতে বাকি থাকে না যারা এই অপকর্মটি করেছে, তারা আমাদের কোন তমসার অন্ধকারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়!
পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতিমান লেখক ও একনিষ্ঠ রোকেয়া গবেষক প্রণোতোষ বন্দ্যোপাধ্যায় একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘হিন্দু-মুসলিম এবং নারী-পুরুষ-নির্বিশেষে বাংলার সমাজ সংস্কারকদের তালিকায় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের নাম রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখের সঙ্গে লিপিবদ্ধ হওয়া উচিত। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে বেগম রোকেয়ার মৃত্যুর ৯২ বছর পরও তাকে যথাযথ সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে শুধু ব্যর্থই হইনি, অজ্ঞতা ও মূর্খতার অস্ত্রে সজ্জিত নির্বোধের মতো তার অস্তিত্ব মুছে দিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এটি কি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা?’
নারীদের ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করার জন্য যিনি তার জীবনের পুরোটাই উৎসর্গ করে গেছেন, সেই মহীয়সী নারীর প্রতিকৃতিতে কালিমা লেপনকারীদের মানসিকতা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। কিন্তু যখন দেখি, আধুনিক কালের কোনো নারী শিক্ষার্থীও সেই একই কাজ করে, তখন তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা তো হয়ই। এমন দৃশ্য আমাদের হতাশায় নিমজ্জিত করে। আধুনিক শিক্ষার নামে আমরা কি অশিক্ষা ও কূপমণ্ডূকতার দিকে অগ্রসর হচ্ছি?
লেখক : সাবেক উপমহাপরিচালক, বিটিভি
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন