ভীতির শাসন বনাম জনগণের অধিকার: রাজনৈতিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা

জনতার ভোটে নির্বাচিত সরকার দেশ-জনতার কল্যাণে কাজ করবে ----

রাজু আহমেদ। কলাম লেখক।

এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমি এইসময়ের মূল্যায়ণ করতে পারছি না। মন্তব্য করতে পারছি না অতীত নিয়েও। ভবিষ্যত বিষয়ক ভাবনার দেয়ালও মনের চৌকাঠে সীমাবদ্ধ! নিকট ভবিষ্যতে কে ক্ষমতায় আসবে, আবার দুর ভবিষ্যতে কারা ক্ষমতায় যাবে- কথা বলার ক্ষেত্রে সেটা আমাকে মাথায় রাখতে হচ্ছে। তারা যদি ক্ষমতায় এসে আমাকে দেখে নেয়! 'তোমাকে দেখে নেওয়া'র প্রচ্ছন্ন-প্রকাশ্য হুমকি থেকে এ জাতির মুক্তি মেলেনি। আদৌ মিলবে কি না- নিশ্চয়াত্মক প্রতিশ্রুতিও কেউ এখনো দেয়নি। অতীতে কেউ কেউ তো সত্যিকারেই দেখে নিয়েছিল এবং ভবিষ্যতেও দেখে নেবে বলে হুমকি দিয়ে রেখেছে। আমরা যেহেতু, এই দেখে নেওয়ার ক্ষমতা যাদের আছে, তাদের অধীনে থাকি তাই আমাদের কথা বলতে হয় সাবধানে। বুকের সব কথা মুখে আনতে পারি না। দেখে নেওয়ার পরিণতি খুব অসাধারণ! যে দেখে নেবে বলেছিল সে সেটা ভুলে গেলেও আমার পাশে যে থাকে, কাছে যে বসে কিংবা আমায় যে জানে সে ক্ষমতার চেয়ারের হাতবদলে ঠিক ঠিক দেখে নেয়। কখনো জীবন নিয়ে, কখনো জেল-জরিমানা খাটিয়ে,  কখনো অঙ্গহানী ঘটিয়ে কিংবা কখনো পালিয়ে বেড়াতে বাধ্য করে- এহেন দেখা ক্রিয়ার স্বার্থক বাস্তবায়ন ঘটায়। কখনো কখনো দেখাদেখিতে চাকুরিচ্যূত হতে হয়, কখনো মানসিক অশান্তিতে ঘুম কেড়ে নেয়। বাংলার রাজনীতিতে এই যে দেখাদেখি- এজন্য সমীকরণ মিলিয়ে কথা বলতে হয়। যারা কথা বলে, লেখালেখি করে তাদের কথা কারো না কারো পক্ষে বিপক্ষে যায়। যাদের বিপক্ষে যায় তারা দেখে নেওয়ার খড়গ ঝুলিয়ে দেয়। আবার যাদের পক্ষে যায় তারাও একসময় ক্ষমতার বিপক্ষে চলে যায়। মধ্যখানে আমজনতা চিড়ে চ্যাপ্টা হয়। সুতরাং কথা বলতে হয় মেপে মেপে। পা ফেলতে হয় চুপে চুপে। কারো সাথে ছবি থাকলেও সেটা দেখে দেখে রাজনীতি হয়! 

 

রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃক এই যে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে রাখা, এটাতে কী তাদেরও মঙ্গল হয়েছে? তারা স্বস্তিতে থেকেছে? ক্ষমতায় থাকার সময়ে নিরঙ্কুশ শক্তি দেখানো এবং ক্ষমতা চলে যাওয়ার পরে চোরের মত পালিয়ে বেড়ানো- এই দেখাদেখির ফল। জনতার ভোটে নির্বাচিত সরকার দেশ-জনতার কল্যাণে কাজ করবে। কাজ-আচরণে জনতা সন্তুষ্ট হলে আবার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে। অসন্তুষ্ট হলে ভোট না দিয়ে আবার জনতার দুয়ারে ফিরতে বাধ্য করবে। অথচ জোর করে ক্ষমতায় থাকা, জনতার সাথে যোগাযোগ না রাখা, বিরুদ্ধমতকে হামলা-মামলা দিয়ে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা- পৃথিবীর সভ্য ইতিহাসে কোথাও এসব ভালো নজির স্থাপন করেনি। কারো প্রতি ক্ষোভ যখন কম থাকে তখন প্রতিক্রিয়াও সাদামাটা হয়। কিন্তু রাগ-ক্ষোভ যদি পাহারসম হয় তখন পতনের আওয়াজ পাতালেও পৌঁছে যায়। সমালোচনা সহ্য করতে না পারা ক্ষমতাশীলদের ক্ষতিপূরণ বাড়িয়ে তোলে। কেউ একটু সমালোচনা কিংবা নিন্দা করলে, বিপক্ষে দু’চারটি কথা বললে কিংবা কোন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে দু’চার হাজার লোক বিক্ষোভ মিছিল করলে তাতে ক্ষমতা চলে যায় না। তবে দীর্ঘদিন বিরুদ্ধমত, ভিন্ন কারো প্রতি সহনশীল না থাকাতে, কারো কথা সহ্য না করাতে, হামলা-মামলা করে বিপক্ষের মতবাদ থামাতে পদক্ষেপ নিলে সেটাই বরং বিপর্যয় ডেকে আনে। যারা সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়, যারা ভুল হলে ধরিয়ে দেয় কিংবা যারা অন্যায়ের প্রতিবাদ জানায় তারা জনপ্রিয়তার পথের বন্ধু। অথচ তাদেরকে শত্রুজ্ঞান করে নিজেদের পথ 'বন্ধুর' করে তুলি। স্বাধীন বাংলাদেশের সমগ্র শাসনের ইতিহাসে উদারতা ও সহনশীলতার এই দৈন্যদশা ধারাবাহিকভাবে চলেছে। ’৯১ এবং ’৯৬ এর নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনায় তুলনামূলকভাবে অনেক ভালো করেছে। আবার এরাই নীতি আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়েছে। বাদবাকি সময়টাতে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার প্রবনতা তীব্রভাবে অনুভূত হয়েছে এবং ক্ষতিপূরণও সাংঘাতিক রকমের বাজেভাবে দিতে হয়েছে; কখনো প্রাণ দিয়ে, কখনো সম্মান হারিয়ে আবার কখনো সম্পদ বিলিয়ে। কাজেই শাসনকালের মেয়াদ(সরকারের এবং সরকার প্রধানের), সরকার প্রধান এবং দলীয় প্রধানের তফাৎ- এই বিতর্কের ফয়সালা দরকার। অন্তবর্তীকালীন সরকার এই সংস্কারটুকু যাতে সারে। 

 

নির্যাতিতের পক্ষে মানুষের সহানূভূতি প্রবলভাবে ক্রিয়াশীল থাকে। মাজলুমের পক্ষে জনমত দাঁড়িয়ে যায়। কেউ এই সময়ে দাঁড়িয়ে বর্তমান সময়ের জন্য উদার ও দায়িত্বশীল মেজাজে কাজ করতে পারবে না, কথা বলতে পারবে না- এতে পরে তাকে দেখে নেওয়া হবে, এই মনোভাব সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এটা শাসকের নয় বরং শোসকের চরিত্র। কাল কে ক্ষমতায় আসবে, পরশু- দিনটি কার?- সেটা মাথায় গেঁথে নিতে বাধ্য হতে হলে এই জাতির মুক্তি অসম্ভব। ’৫৪ বছরের শাসন ও শোসনের ইতিহাস, দীর্ঘকালের ক্ষমতা ও পতনের ইতিহাস থেকে ক্ষমতা ও জনতা- উভয়ের শিক্ষা হওয়া উচিত। যে রাজনীতি জনতার জন্য, যে রাজনীতি মাটি ও মানুষের জন্য, যে রাজনীতি দেশ ও দশের জন্য সেখানে প্রতিহিংসাপরায়নতার প্রশ্ন আসাই উচিত নয়। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের চিত্রে দেখা গেছে, রাষ্ট্রকে ফাংশনিং করার অর্গানগুলো ভবিষ্যত ক্ষমতার দিকে তাকিয়ে কেউ শীতনিদ্রায় গেছে আবার কেউ অতিরিক্ত ক্রিয়াশীল হয়েছে। দায়িত্বশীলের আচরণ তো এমনটা হওয়া উচিত নয়। অতীতের ইতিহাস বলছে, এখানে পুরস্কৃত হওয়া এবং শাস্তি পাওয়া নিরপেক্ষ কাজের ওপর নয় বরং অন্ধভাবে দলান্ধতা কিংবা দলবিরোধীতার ওপর নির্ভর করে। রাষ্ট্রের আমলা-পুলিশ, শিক্ষক-বিচারক রাষ্ট্রের নয় বরং দলের পদালিতে পরিণত হয়। সাধারণ মানুষও নগ্নভাবে দল-সরকার-রাষ্ট্র একাকার করে ফেলছে। রাজনৈতিক দলগুলোই যখন সরকার হয়ে ওঠে এবং সরকারে থেকে একপার্শ্বিক নিজস্ব ইজম প্রচার-প্রসারে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে অপব্যবহার করে তখন আর পার্থক্য করার উপায়ও থাকে না বটে। 

 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছাত্রজনতা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সংস্কারের যে মহান দায়িত্ব দিয়ে শাসনভার অর্পণ করেছে তা পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য সময়, সুযোগ এবং সহায়তা রাজনৈতিকদলগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া উচিত। তাড়াহুড়ো করে নির্বাচনের আয়োজন করে গতানুগতিক নিয়মে আরেকটি দল সরকার গঠন করবে বটে কিন্তু রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে রিপু তা আদৌ দূর হবে না। এতে আবার কয়েক বছর পরে সে সরকারটিও স্বৈরাচারের তকমা নিয়ে উৎখাত কিংবা পতন হতে বাধ্য হতে হবে। ক্ষমতার লোভ, অর্থের লোভ শাসকের বিবেকবোধে লোপ ঘটায়। শাসক বলতে কেবল দলের শীর্ষ নেতা, হাই-কম্যান্ড, যারা সংসদে যাবে কিংবা যারা জেলা-উপজেলার নেতা হবে তাদেরকে বোঝাচ্ছি না বরং ইউনিয়েনের একজন কর্মী, গ্রামের একজন সমর্থক- তাকেও সিস্টেমের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। কোন দলের ওপরে যে মানুষের বিতৃষ্ণা জাগে, বিরুদ্ধাচারণ করে তা কি কেবল বড় বড় নেতাদের আচরণে? খুব সমান্যই। জনতার সাথে আসলে তারমতো সাধারণ জনতার দেখা হয়- তাদের আচরণ ব্যবহারেই দলের বদনাম হয়। ইউনিয়ন পর্যায়ের একটা হাট থেকে কোন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতার নির্দেশে নিশ্চয়ই চাঁদা তোলা হচ্ছে না! কাজেই আমাদের সামগ্রিক শোধন দরকার। এটা সম্ভব হতে পারে কেবল সৃশৃঙ্খল পদ্ধতি প্রণয়ের মাধ্যমে। দ্রুত নির্বাচনের জন্য চাপ না দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে পরামর্শ দিয়ে, পাশে থেকে এই সংস্কার করিয়ে নেওয়া আবশ্যক। যে সিস্টেমে ’৫৪ বছরের বাংলাদেশে চলেছে সেভাবে তরুণরা আর এই বাংলাদেশকে চলতে দেখতে চায় না।  জীবন দিয়ে, অঙ্গহানী করে দেশের ছাত্র-জনতা কেবল ভোটাধিকারের জন্য এহেন আত্মত্যাগ করেনি। রাজনৈতিক দলগুলো নাগরিকের স্বপ্ন পূরণের সহায়ক হোক। সিঙ্গাপুর-সুইজ্যারল্যান্ড হওয়ার সব রসদ আমাদের আছে। শুধু দরকার একটু ধৈর্য এবং একটি ভালো পদ্ধতি। নোবেল বিজয়ী ডা. মুহাম্মদ ইউনূস সরকরের ওপর সেই আস্থাটুকুন রাখা যায় কিনা- ভেবে দেখবেন। 

 

“আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি”- মিথ্যা কথা। আমার মতো লাখো আমজনতা জাতীয় সংগীতের এই পংক্তি গাইতে গাইতে মুখে ফেনা তুলে ফেললেও রাষ্ট্রের খুব বেশি উপকার হয় না। কিন্তু যারা এদেশের মেরুদন্ড বিদেশে পাচার করে দিয়েছে, দেশের স্বার্থবিরোধী চুক্তি করেছে, দেশকে লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে- তাদের মনে দেশেকে ভালোবাসার তথা দেশপ্রেমের অনুভূতি জাগ্রত করতে হবে। যদি বোঝানোতে বুঝতে বাধ্য না হয় তবে তাদেরকে দেশবিনাশী কাজ থেকে বিরত রাখতে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। শাস্তি দিতে হবে- প্রয়োজনে ফাঁসি। দেশের স্বার্থ সবার চেয়ে বড়। এই দেশের ওপর কোন শকুনের নজর পড়বে এবং কোন দেশপ্রেমিকের শরীরে এক ফোঁটা রক্ত থাকতে সেটা মেনে নেওয়া হবে– এটা দুঃস্বপ্ন। সিপাহী-জনতার জাগরণ একাত্তুরে হয়েছে, ’৯০ এরটা শুনেছি এবং ’২৪-এ দেখেছি। যারা দেশবিরোধী চক্রান্ত করছে তাদের সাবধান হওয়া উচিত। প্রত্যেক অপপ্রচারের জবাব দেশের জন্য দেবে। বাংলাদেশকে নিয়ে যারা বিভিন্ন দেশে ষড়যন্ত্র করছে তারাও হুশিয়ার হোন। দাবি আদায়ে যারা হাসিমুখে জীবন দেয়, দেশ বাঁচাতে যারা অগ্রগামী হয়ে বুলেট-বেয়নেটের আঘাতে রক্ত দেয় তাদের দমাবেন কী দিয়ে? কী কী অস্ত্র আছে? জনতার জোয়ার থামাতে ব্যর্থ হবেন। পারলে শুধরে আসেন। কাজেই অতীতের শাসক এবং ভবিষ্যতের শাসক- সাবধান। পাহাড়াদার হয়ে রাষ্ট্রের মালিক হয়ে উঠতে চাইলে জনতা ঠ্যাং ধরে টেনে-হিঁচড়ে নামায়- আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত তো অনেকগুলো। কাজেই কাউকে দেখে নেওয়ার যে হুমকি এতে আপনাদেরকে আরও অজনপ্রিয় করে- এটা যতদ্রুত অনুধাবন করতে পারবেন ততদ্রুত আপনাদের মঙ্গল হবে। ধমক তুলে নিয়ে দেশ ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে দিন। কথায় কথায় যে দেশপ্রেমের কথা বলেন সেটায় ঈমান আনয়ন করে বাস্তবায়ন করুন। এতে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষ সকলের কল্যাণ হবে।আপনার/আমার কল্যাণ তো সবার আগেই হাসিল হবে। 

 

 

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন