এই সামান্য বিষয়টি প্রেমিকা বোঝে অথচ ভারত বোঝে না?
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
চোখে চোখে কথা এবং চোখ চোখ রেখে কথা বলার মধ্যে ব্যবধান আছে। এই সামান্য বিষয়টি প্রেমিকা বোঝে অথচ ভারত বোঝে না? বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কারো সাথে চোখে চোখে নয় বরং চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে। সামরিক সক্ষমতায় কে কতো এগিয়ে, জনসংখ্যায় কোন দেশ পিছিয়ে- এইসব ভেবে দেশের স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়ে কথা বলার সুযোগ নাই। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে বাংলাদেশ সবসময় আপসহীন। ন্যায্যতা মানে যদি সংখ্যায় অল্পও হয়, শক্তিতে দুর্বলও হয় তবুও যা যৌক্তিক তা স্বীকার করতে হবে। সঠিক কথা একজন মানুষ বললেও তা মানতে হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিষয়ে কেউ হুমকি দেবে আর নাগরিক হিসেবে নতজানু হয়ে তা মেনে যাবো- সেদিন বাসী হয়েছে। মৃত্যু আজ না হলেও কাল হবে। কাজেই দেশের জন্য একদিন আগে মৃত্যুবরণ করতে হলে সেটা হাসতে হাসতে বরণ করে নেবো। স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে দেশের স্বার্থে মৃত্যু কোটিগুণ মর্যাদাবান-শ্রেষ্ঠ। দেশের জন্য যারা জীবন দেয় তারা শহিদ। আর যারা বাঁচে তাঁরা গাজী।
ভারত যেভাবে বাংলাদেশ বিষয়ে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, উগ্রতা দেখাচ্ছে- সেটা চরমভাবে আপত্তিকর এবং নিন্দনীয়। কোন দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে অন্য কোন দেশের সরকার ও জনগণের ঔদ্ধত্য ও নগ্ন মন্তব্য সভ্য-ভদ্র সম্পর্কের বিপরীত। বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের সাথে ভারতের অবদান স্বীকার্য তবে তার অর্থ এই নয় যে, ঋণ শোধ করতে গোলামির জিন্দেগী কবুল করতে হবে। সম্পর্ক হবে ন্যায্য ও সাম্যের। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে শত্রুতা আমাদের কাম্য নয় কিন্তু আগরতলাস্থ বাংলাদেশের উপহাইকমিশনে যে বর্বরোচিত হামলা হয়েছে তা অকল্পনীয় ও নিন্দনীয় । ভারত সরকার নিজ দেশে উগ্রতা দমন করতে পারছে না- এটা তাদের ব্যর্থতা কিন্তু বাংলাদেশেন অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে তারা যেভাবে নগ্ন মন্তব্য করছে তা ধৃষ্টতার শামিল।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোন অপতৎপরতা সহ্য করা হবে না- এ ব্যাপারে সমগ্র বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ। ভারত যে ঔদ্ধত্য দেখাচ্ছে তাতে তাদের সাথে নরম সুরে কথা বলার, তোষণ করার সুযোগ নাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের চেয়ে বড় কোন প্রায়োরিটি এদেশীয় জনগণের সামনে নাই। মাতৃভূমি নয়তো মৃত্যু'র- যে শপথ দেশবাসী বুকে ধারণ ও লালন করছে তা যদি ভারতীয় শাসকদল উপেক্ষা করে, এদেশের জনগণের রাগ ও ক্ষোভের ভাষা না বুঝতে পারে তবে তাদেরকে খেসারত দিতে হবে। বাংলাদেশ ভালো না থাকলে ভারতের ভালো থাকার কোন সুযোগ নাই। আমাদের মধ্যে দল-মত, ধর্ম-গোত্রের বিভাজন থাকতে পারে কিন্তু দেশপ্রেমের প্রশ্নে একচুলও ছাড় দেওয়া হবে না। এদেশের মাটি, জাতীয় পতাকা কিংবা মানচিত্র রক্তের দামে কেনা,রক্ত দিয়ে কেনা। এসবের সম্মান রক্ষার জন্য যত রক্ত দরকার তা দিতে বাংলাদেশীরা কখনোই কুণ্ঠিত হবে না।
বাংলাদেশ বিষয়ে ফ্যাক্ট চেক করে ভারতীয় শাসকদের মন্তব্য করা উচিত। প্রতিবেশীদের সাথে বিমাতাসূলভ আচরণের কারণে সীমান্তে ভারতের কোন বন্ধু রাষ্ট্র নাই। এতোদিন বাংলাদেশ ভারতকে সমীহ করেছে কেননা শাসকদের ক্ষমতায় থাকার জন্য ভারতকে দরকার ছিল। সেদিন এখন অতীত, দূর পরবাসে। সরকার টু সরকারের এককেন্দ্রিক সম্পর্কের কারণে ভারতের শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের ঘৃণা এবং ক্ষোভ উচ্চপর্যায়ে। ভারত বাংলাদেশকে অঙ্গরাজ্যের মত ব্যবহারের যে ইশতেহার পেয়েছিল তা হারিয়ে ভারত অনেকটা উম্মাদ এখন। এই উম্মাদনা ভারতের রাষ্ট্রসীমার মধ্যে সীমিত থাকলে সেটা ঠিকাছে কিন্তু যদি তা সীমানা অতিক্রম করে বাংলাদের ত্রিসীমানায় অনুপ্রবেশের দুঃসাহস দেখাউ তবে সেজন্য ভয়ানক খেসারত দিতে হবে।
ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার এবং জনগণের যে রাগ-ক্ষোভ সেসবের জন্য এককভাবে ভারত দায়ী। বাংলাদেশের সাথে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নির্মাণে ভারত কখনোই বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়নি। এমনকি সমতাসূলভ আচরণ না করে প্রভূত্ব কায়েম করেছিল। যার প্রমাণ সীমান্তে কাঁটাতার, ফারাক্কা ও তিস্তা বাঁধ। রোহিঙ্গা ইস্যু এবং সীমান্ত হত্যা আমরা ভুলে যাইনি। এতোদিন ভারত যা চেয়েছে তারচেয়ে বেশি পেয়েছে বলে দিন দিন যে লোভ বেড়েছে তা পূরণে ছেদ পড়াতে পাহারাদার জন্তুর মতো একদল ডাকাডাকি শুরু করেছে।
ভারতের তরফ থেকে মাঝে মাঝেই পেঁয়াজ-আলু-মরিচ আমদানি বন্ধের যে হুমকি আসে সেটা ফয়সালা হওয়া উচিত। দুনিয়ায় বিকল্প বাজারের অভাব নাই। আমরা পয়সা দিয়ে কিনি; কারো থেকে মাগনা নেই না। ভারত থেকে এসব না আসলে বাংলাদেশ কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বটে কিন্তু ভারতে উৎপাদিত এ সকল পণ্য বিক্রির জন্য বাংলাদেশের বাজারের মত এমন লাভজনক বাজার বিশ্বের কোথাও তারা পাবে না। সেহেতু বাংলাদেশের জনগণকে হুমকি মানে ভারতের কৃষককে পরোক্ষভাবে হুমকি প্রদান। দিল্লি অভিমুখে ইন্ডিয়ান কৃষকদের আন্দোলন র্যালি নিশ্চয়ই বিজেপি সরকারের মনে এখনো আতঙ্ক হিসেবেই আছে। দুধ রাস্তায় ঢেলে দিয়ে প্রতিবাদের চিত্র ভারত সরকার ভুলে গেছে?
প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক নষ্ট হোক- সেটা আমরা চাই না। তবে ভারতে বাংলাদেশ বিষয়ক যে গুজব ও অসত্য চলছে, যে উগ্রতা ও নীতির নগ্নতা চলছে তা অবিলম্বে বন্ধ করা দরকার। সরকারের সাহসী প্রতিবাদে সেটার বাস্তবায়ন অচিরেই দেখবো। আগষ্ট পরবর্তী উচ্চ শিরের সরকারের সাহসী উচ্চারণে সীমান্ত হত্যা গত তিনমাসে প্রায় শূণ্য। পরিবর্তন টের পাচ্ছেন? কোন দেশ সম্পর্কে মন্তব্য করার আগে ভারত সরকারের দায়িত্বশীলদের বারবার ভাবা উচিত। আধুনিক বিশ্বে কেউ কাউকে তোয়াক্কা করে না যদি পারস্পরিক সম্মান না থাকে। ইন্ডিয়ান কিছু উগ্রপন্থী গণমাধ্যম এবং একটি গোষ্ঠীর স্বার্থপর প্রচারণার জন্য বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক তিক্ত হচ্ছে। এটা আকাঙ্ক্ষিত নয়। দু'দেশের জনতার মঙ্গলের জন্য রাষ্ট্র দু'টির ঐতিহাসিক সম্পর্ক ধারাবাহিক করা এবং জনগণের মধ্যকার ব্যবসা বাণিজ্য সুচারুভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আলোচনায় বসা উচিত। প্রতিবেশীর দ্বন্দ্বে কেউ শেষমেশ জেতে না। কাজেই তৃতীয়পক্ষের স্বার্থের বলিদানে বন্ধুপ্রতীম দেশ দু'টো ভুক্তভোগী হোক- এটা কাম্য নয়। সতরাং দুই দেশের সরকারের উচিত আন্তরিক আলোচনা ও নমনীয় নীতির মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে পৌঁছানো।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন