জিবি নিউজ প্রতিনিধি,,
মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৫ ডিসেম্বর সিলেটবাসীর জন্য একটি ঐতিহাসিক ও গর্বের দিন। এই দিনে সিলেটের মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করেন। রক্তক্ষয়ী ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জন হয় এই অনন্য গৌরবমাখা ক্ষণটি।
১৯৭১ সালের এই দিন সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা বীরের মতো সিলেট শহরে আসতে শুরু করে। অন্যদিকে শহর থেকে পালাতে শুরু করে পাক বাহিনীর দোসর আলবদর, রাজাকার, আল-শামস বাহিনীর সদস্যরা। তাই ১৫ ডিসেম্বর সকালের চিত্রটা ছিলো অন্যদিনের চেয়ে আলাদা। অন্য এক আনন্দ প্রবাহ বয়ে গেছে সিলেটের আকাশ জুড়ে। বজ্রকন্ঠে বেজে উঠে জয়ধ্বনি।
সেদিন রাজপথ শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত ছিলো। প্রকম্পিত হয় সেদিনের প্রহর। সিলেট শহরজুড়ে ছিলো জনতার উচ্ছ্বাস। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বয়সী মানুষের মিছিল মিশে গিয়েছিলো এক মোহনায়। সব কণ্ঠস্বর এক স্রোতে মিশে গিয়েছিল সেদিন।
১৯৭১ সালের সেই দিনগুলো সিলেটবাসীকে তুমুলভাবে নাড়া দিয়েছিল। স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সারা দেশের মতো সিলেটের সর্বস্তরের মানুষ ছিলো ঐক্যবদ্ধ। পাকিস্তানি দোসররা বাঙালি জাতির উপর নির্লজ্জভাবে সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। তাই বলে হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি সিলেটের মুক্তিপাগল মানুষ। সকল শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেই রুখে দাড়ায় তাঁরা। সেদিন সিলেটের অনেক এলাকা জ্বলে-পুড়ে ছারখার হচ্ছিলো। চারদিকে জ্বলছিল আগুনের লেলিহান শিখা। বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল আলী আমজাদের ঘড়ি। কিনব্রিজ হয়েছিল দ্বিখন্ডিত। ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল বিভিন্ন স্থাপনা।
একাত্তারের ৬ ডিসেম্বর থেকে সিলেট শহরে পাক হানাদার বাহিনীর উপর প্রচন্ড বিমান হামলা চালায় ভারত। এই হামলা ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত ছিলো। ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল খাদিমনগর এলাকায় এসে অবস্থান নেয়। একই দিন মুক্তিযোদ্ধাদের আরও কয়েকটি দল দক্ষিণ জালালপুর ও পশ্চিম লামাকাজিতে আসে। তখন ফাঁকা ছিলো শুধু উত্তর দিক। কিন্তু সেদিকে সীমান্তবর্তী পাহাড় ও বনাঞ্চল থাকায় দোসরদের পালাবার কোনো পথ ছিলো না।
হঠাৎ দু’জন তরুণ বীর মুক্তিযোদ্ধা ফোরকান আলী (কুটু মিয়া) ও আনোয়ার হোসেন গোরা খাদিমনগর থেকে একটি গাড়িতে চড়ে পাকিস্তানি দোসরদের আত্মসমর্পণের জন্য বেশ কয়েক ঘণ্টা শহরে মাইকিং করতে থাকেন। তাদের সেই মাইকিংয়ের মধ্যদিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে নতুন করে সাহসের সঞ্চার হয়। তখন উত্তপ্ত সিলেট শহর।
এদিকে, মাইকিং করতে করতে সাহসী দুই মুক্তিযোদ্ধা ক্রমান্বয়ে শহরের দিকে আসেন। পথে পথে, বাসা-বাড়ি, দোকানপাটে থাকা উদ্বিগ্ন মানুষ তাদের কণ্ঠের ধ্বনি শুনে ঘর থেকে রাস্তায় নেমে এসে তাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন। অনেকেই তাদের উদ্দেশ্যে শ্লোগান তোলেন। যে গাড়িতে মাইকিং চলছিল সেই গাড়ির পেছনে আরেকটি গাড়িতে করে শহরের দিকে আসছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উত্তর অঞ্চলের বেসামরিক উপদেষ্টা, তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য প্রয়াত দেওয়ান ফরিদ গাজী ও মিত্র বাহিনীর অধিনায়ক কর্ণেল বাগচী। শহরের যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে লোকজন বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাদের দেখছিলেন। তখন হানাদারদের অবস্থান ছিলো সিলেট সরকারি কলেজের আশপাশে।
প্রকাশ্যে আসতে না পারলেও গোপনে তারা সংগঠিত হওয়ার জন্য শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু মাইকিং করার পর শত্রুরা আত্মসমর্পণের বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়। ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের খাদিমনগরের দিকে ফিরে যেতে হয়। ওই দিন কদমতলী এলাকায় ঘটে আরেক ঘটনা। একটি ইটখোলায় থেকে যাওয়া ২১ জন পাকিস্তানি সৈন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন ৩৫ জনের মিত্র বাহিনীর একটি দল। ওই দলের সঙ্গে সেদিন মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল হক, গামা, আফরাইন, আব্দুল মতিন, ম.আ. মুক্তাদির, মনির উদ্দিন, ইশতিয়াক আহমদ, বেলায়েত হোসেন, বেলায়েত হোসেন খান, জামানসহ ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে ওইদিন মোকাবেলা করেছিলেন শত্রুদের।
প্রায় ৯ ঘণ্টা সম্মুখ যুদ্ধের পর নিরুপায় হয়ে পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণের পথ বেছে নেয়। এরপর শুরু হয় আরেক অধ্যায়। মাছিমপুর থেকে নিক্ষিপ্ত একটি শক্তিশালী মর্টার এসে আঘাত করে সুবেদার রানাকে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিহত হন। আহত হন মিত্র বাহিনীর আরও দুই সদস্য।
তবে, তাদের নাম সেদিন জানা ছিলো না কারো। পরে ১৪ ডিসেম্বর সরকারি কলেজের আশপাশ থেকে শত্রুরা তাদের অবস্থান তুলে নেয়। ওইদিন দুপুরে দেওয়ান ফরিদ গাজী ও কর্নেল বাগচী বিনা প্রতিরোধে শুধু শহরেই নন, বিমানবন্দরের পাশে গড়ে উঠা শত্রুদের মূল ঘাঁটির কাছাকাছি পর্যন্ত ঘুরে আসেন। ইতোমধ্যে ‘জেড’ ফোর্স’র সেনারা এমসি কলেজ সংলগ্ন আলুরতলে সরকারি দুগ্ধ খামারের কাছে পৌঁছে যান। তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা সবদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
ওইদিন সন্ধ্যায় চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর জওয়ানরা দলবদ্ধভাবে এবং স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের কোলাহলে মুখর হয়ে উঠে সিলেট শহর। পাড়া-মহল্লা, অলিগলি পর্যন্ত এই খবর পৌঁছে যায়। ‘জয় বাংলা, জয় বাংলা’ শ্লোগানে ভারী হয় বাংলার মাটি। পরদিন ১৫ ডিসেম্বর সকালে সকল বয়সী মুক্তিপাগল মানুষের ঢল নামে সিলেট শহরে। তাদেরকে ঘিরে ভিড় জমে পথে পথে। ঘড়িতে তখনো ১২টা হয়নি। শহরবাসী মাইকের মাধ্যমে উচ্ছ্বাস ভরা কন্ঠে গোটা সিলেটে প্রচার করতে থাকেন ‘সিলেট আজ হানাদারমুক্ত’ সিলেট আজ হানাদার মুক্ত’।
সেই থেকেই প্রতি বছর ১৫ ডিসেম্বর সিলেট মুক্ত দিবস পালিত হয়ে আসছে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন