সম্প্রীতির বাংলাদেশে বিভাজনের কালোছায়া!

যেকারো ধর্ম পালনের অধিকার এখানের সবার আছে কিন্তু সেটা দেশের সার্বভৌম-স্বাধীনতার ওপর আঘাত আনলে তবে

রাজু আহমেদ,  প্রাবন্ধিক।  

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস যদি একজন ধর্ম প্রচারক এবং ধর্মপালনকারী হয় তবে গোটা রাষ্ট্রের, সমগ্র জাতির সম্মিলিতভাবে তাকে সেই সুযোগ করে দেওয়া কর্তব্য। ধর্ম পালনের এবং ধর্মের প্রতি প্রীতি বিলানোর জন্য চিন্ময় দাসদের সহযোগিতা করা রাষ্ট্রীয় ফরজ। তবে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস'রা যদি কোন রাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়, কোন রাজনৈতিক দলে খায়েশ পূরণ করতে আভিভূর্ত হয়, দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে চায় কিংবা কোন সূক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায় তবে সব অপচেষ্টা রুখে দিতে হবে। সকল অপতৎপরতা রুখে দেওয়া ছাত্র-জনতার জন্যও ফরজ। দেশপ্রেম ঈমানের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দেশ বাঁচানোর তামান্নায় শহিদী মৃত্যু বেঁচে থাকার চেয়ে হাজার কোটি গুণ শ্রেষ্ঠ। শহীদ আবরার আসাদের সে পথ দেখিয়ে গেছেন। 

 

হিন্দুত্ববাদ ধর্ম এবং ইসকন একটি সংগঠন। যে জয়শ্রী রাম স্লোগান নিয়ে ভারতে বিতর্কের শেষ নাই সেই জয়শ্রী রাম স্লোগান বাংলাদেশের বুকে নির্বিঘ্ন হইবে- এটা ভাবার কোন কারণ নাই। দেশের স্বার্থ সবার আগে। সংখ্যালঘু সুরক্ষার জন্য ইসকনের নেতৃত্বে যে আটদফা সেটার অনেকটাই যৌক্তিক। তবে অটোরিকশার আন্দোলন, শ্রমিকদের আন্দোলন, কিস্তিওয়ালাদের আন্দোলন, আনসারদের আন্দোলন কিংবা বুয়াদের আন্দোলনের সমকালে ইসকনের বিভাগ ও ঢাকামুখী আন্দোলনের নেপথ্যের কারণ কেবল ৮দফা দাবির বাস্তবায়ন - হিসাব মেলানো কঠিন হচ্ছে। দেশ যে অস্থিতিশীলতার দিকে যাচ্ছে। 

 

বাবু গয়েরশ্বরের মাথা ফাঁটানো, নিপুনকে জেলে নেওয়া, সুরেন্দ্র কিমার সিনহাকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া কিংবা বিশ্বজিতকে কুপিয়ে হত্যা করা- তখনও ইসকন ছিল। সংখ্যালঘু প্রত্যয়টিও ছিল। তখন একটি মৌখিক বিবৃতি না দেওয়া এবং এখন চিন্ময় দাসকে ঘিরে দেশ অচল করার আলোচনা- ঘোরতর সন্দেহ ঠেকছে। যেকারো ধর্ম পালনের অধিকার এখানের সবার আছে কিন্তু সেটা দেশের সার্বভৌম-স্বাধীনতার ওপর আঘাত আনলে তবে সেটা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও ঠেকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব মানুষ এখানে এক প্লাটফর্মে দাঁড়াবে।

 

বাংলাদেশের হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই। কাদের চক্রান্তে, কোন ষড়যন্ত্রে হাজার বছরের সম্প্রীতির ওপর আঘাত আসছে- সেটা দু'পক্ষের ভাবা উচিত। পৃথিবীতে ভারত একমাত্র রাষ্ট্র যার কোন প্রতিবেশী দেশের সাথে সুসম্পর্ক নাই। এমনকি ৯৭% নাগরিক সনাতন হওয়ার পরেও ক্ষুদ্র নেপালের সাথেও তাদের বৈরিতা। চীন-পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সাথে সম্পর্কের কথা আর না বলি। সব খারাপ আর আমি ভালো- এই ধারণায় দুনিয়া চলে না। বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দলকে বেছে নেওয়া- ভারতের ঐতিহাসিক ভুল হিসেবে অচিরেই আত্মপ্রকাশ ঘটাবে। যে দলের সমর্থন তারা দিচ্ছে সেটাও যদি অচিরে বাংলাদেশের শাসনক্ষমতা পায় তবুও বাংলাদেশের জনগণের সাথে যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে সেটার খেসারত ভারতকে আজ অথবা কাল দিতে হবে। আজন্ম এ লজ্জা বয়ে বেড়াতে হবে। রাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোন দেশ নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষ অবলম্বন করতে পারে না। এটা ভদ্রোচিত কূটনৈতিক সম্পর্কের খেলাপ। 

 

ইসকন বিশ্বজুড়েই কমবেশি বিতর্কিত সংঘঠন। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রায় নাজুক। অথচ এই সরকার কোন প্রমাণ ছাড়া ভারত ও ইসকনের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে চিন্ময় দাসকে গ্রেফতার করেছে?- পাগলেরও এটা বিশ্বাস করা উচিত নয়। তারপরেও কেউ যদি অন্যায়ভাবে আটকও হয় তবে সেটা মোকাবিলা করার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় আইন-আদালত। মানুষ হত্যা করা, আদালত ঘেরাও করা, আইনজীবীদের প্রহার করা কিংবা বিচারকদের আল্টিমেটাম দেওয়া- এসব প্রজ্ঞাবান সনাতনপ্রথার সাথে যায় না। যে ভুল হয়েছে সেটা ঐতিহাসিক ভুল এবং এর খেসারত ইসকনকে দিতে হবে। 

 

বাংলাদেশের জাতীয় কবি সন্তানদের নাম রেখেছিলেন কৃষ্ণ-মোহম্মদ, অরিন্দম-খালেদ অথচ সেই কবির দেশকে বারবার ধর্মীয় সংহিতার বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে। এর দায় কেবল হিন্দুদের নয় বরং মুসলিমদেরও আছে! যে ছেলেটা বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাথে মিলেমিশে ত্রাণ দিয়েছিল, সহনশীলতার কথা বলেছিল সে আজ নাই। নৃশংসতার নগ্নতা দেখে গেলো। এই ট্রাজেডি জাতিকে ক্ষমা করবে? রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসকনের মোকাবেলা করতে হবে। ইসকনের সাথে কোন ব্যক্তিকেন্দ্রিক শত্রুতা দেখানো যাবে না। আমরা হিন্দু ভাইবোনকে মানসিক নিরাপত্তা দিতে পারিনি। তারাও আমাদের আপন ভাবেনি এবং আমরাও তাদের পাশে থাকিনি! অতীতের এই দূরত্বেই বর্তমানের ফাটল। 

 

এই বাংলাদেশে যতটুকু মুসলিমের ঠিক ততটুকু হিন্দুদের। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্য। এখানে ফাটল ধরানো কোনভাবেই ঠিক হবে না। মিলেমিশে থাকার জন্য যা যা দরকার তা সম্মিলিতভাবে করতে হবে। বুকে বুক মিলিয়ে না থাকলে মানবিকতা বাঁচবে না। যদি উগ্রতা দেখাই তবে আমাদেরকেও আবার ট্রেন টু ইন্ডিয়া লিখতে হবে!  যদি কোন পাতানো ফাঁদে পা দেন তবে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকে জিতিয়ে দিচ্ছেন। সহ্যের সর্বোচ্চ বজায় রাখুন। এই বাংলাদেশ মানুষের হোক- প্রত্যাশায়। আমাদের আসল উদ্দেশ্য শিক্ষিত হওয়া নয় বরং সহনশীল মানুষ হওয়া। আমরা আর কোনোদিন সহনশীল হতে পারবো কি-না জানিনা। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। সহিংসতা দেখে সবাই আনন্দ করে। আমাদের পরিণতি আসলে ভালোর দবকে যাচ্ছে না। 

 

হিন্দুধর্ম শান্তির ধর্ম কিন্তু ইসকন নিঃসন্দেহে উগ্রতাবাদী কর্মকান্ডে জড়িত। কাজেই দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার প্রশ্নে ইসকনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।  এই সরকার রাজনৈতিক বিবেচনায় দুর্বল হলেও দেশের সর্বোচ্চ সংখ্যক ছাত্র-জনতার অকুণ্ঠ সমর্থন সরকারের সাথে। কাজেই দেশের স্বার্থ, ধর্মবিশ্বাসের সম্প্রীতি এবং সহাবস্থান নিশ্চিতের জন্য ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে ইস্পাত-দৃঢ় ঐক্য গড়তে হবে। আমরা পরস্পরের ভাই। কেউ কাউকে কাল্পনিক শত্রু ভাবলে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জীবনের চাইতে এই দেশের পতাকাকে সমুন্নত রাখতে বেশি গৌরবের মনে করা প্রজন্ম কখনো হারে না।

 

 

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন