মানুষ কখন কঠোর হতে বাধ্য হয়? যখন অন্য মানুষ তাকে পেয়ে বসে। যে বুঝতে পারে অন্যরা তাকে ব্যবহার করছে -----
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
মানুষ সহজাত বা স্বভাবজাতভাবে কঠোর হৃদয়ের নয়। তাঁর সাথে ঘটে যাওয়া আচরণ, পারিপার্শ্বিকতা এবং বাস্তবতার আলিঙ্গনে সে কঠোর হতে বাধ্য হয়। নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে কখনো কখনো কঠোরতাই চিকিৎসার শেষ টিকা। পরিবেশ-পরিস্থিতি মানুষের দিলকে ক্ষতবিক্ষত করে এতোটাই শক্ত করে যাতে সে চেষ্টা করেও আর স্বাভাবিক আচরণ করতে পারে না। কিংবা নতুন করে আর আঘাত না পাওয়ার ভয়ে কঠোরতার মোড়কে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। কথা বললে মনে হয় যেন অভেদ্য দেয়াল। যে ঠকেছে, যে হারিয়েছে কিংবা যাকে প্রতারিত করার হয়েছে ন্যায্যতা থেকে- সে চাইলেও আর স্বাভাবিক বিশ্বাসে ফিরতে পারে না।
মানুষ কখন কঠোর হতে বাধ্য হয়? যখন অন্য মানুষ তাকে পেয়ে বসে। যে বুঝতে পারে অন্যরা তাকে ব্যবহার করছে সে ঘুরে দাঁড়ায়। সবার নির্দিষ্ট সহ্যসীমা আছে। যখন তা কেউ অতিক্রম করে তখন কথা ও আচরণে কঠোরতা টানতে বাধ্য হতে হয়। যাদের সাথে প্রাণ খোলা আড্ডা হতো, যারা থেকেছিল জীবনের অংশ হয়ে তাদের সাথে বিচ্ছেদের গল্প একদিনে তৈরি হয়নি। যাকে ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব মনে হতো- তাকে ফিরিয়ে দেওয়া কিংবা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অভ্যাস একবারেই সৃষ্টি হয়নি। এই যে 'না' বলতে পারার ক্ষমতা অর্জন সেজন্য বহুবার ভাবতে হয়েছে, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা লেগেছে। মানুষ যদি মানুষের সাথে মানুষের মত আচরণ করতো তবে কারো স্বভাব এতো কঠোর-কঠিন হতো না। হওয়ার প্রশ্নও ছিল না।
জীবনটা আসলে ছোটখাটো যুদ্ধক্ষেত্র। এখানে শত্রুর ষড়যন্ত্র এবং বন্ধুর সহায়তা না করা- উভয় রূপই বিদ্যমান আছে। এখানে কেউ নির্মমভাবে আঘাত করেছে আবার কেউ হাসতে হাসতে ঠকিয়ে গেছে। বিশ্বাস ভেঙে যারা আনন্দ করেছে, ভরসা দিয়েও যারা পাশে দাঁড়ায়নি কিংবা হাত ধরেও যে একসাথে চলেনি- এই সবকিছু মিলিয়ে মানুষের মনটা আর কোমল থাকেনি। সে সহ্য করেছে কথার হিংস্রতা। মন দেখেছে প্রিয়জনের পাল্টে যাওয়া এবং শুনেছে মনুষ্যত্বের বদলে দানবতার গল্প। তখন মানুষ নিজেকে রক্ষা করতে কঠোর হয়েছে। আঘাত থেকে বাঁচতে নিজের চারপাশে তুলেছে প্রাগৈতিহাসিক প্রাচীর। এবং কষ্ট না পেতে নতুন করে আর কাউকে করেনি বিশ্বাস।
কল্পনা করুন, মানুষ যদি কোমল-নরম আচরণ করতো, সবাই সহজ-সরল জীবন যাপনে অভ্যস্থ থাকতো এবং বিশ্বাসকে রাখতে অটুট- তবে কী সৌন্দর্যের মধ্যে মানুষের গড়তো আবাস? অথচ মানুষ স্বার্থ নিয়ে ঝগড়া করে, কথার আঘাতে চোখে পানি আনে কিংবা একে অপরকে খুন-জখম করে। এই দুনিয়ায় যে যতখানি কঠোর হয়ে সে তার স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছে তার অধিক। মানুষ যদি নরম থাকে, স্বার্থ উদ্ধারে শরম করে তবে তাঁর পোশাক নিয়েও অন্যরা টানাটানি শুরু করবে। সম্পদ দখল করবে তো আগেই। মানুষ আচরণ দিয়ে মানুষকে কঠোর বানিয়ে এখন আবার অন্যকে দোষে! কী বিচিত্র স্বভাবের মানুষ!
কঠোরতার চেয়ে কোমলতা নিঃসন্দেহে ভালোগুণ। তবে কঠোরতাও অলঙ্কার যখন সে বিচারক-প্রশাসক। তবে সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক স্বভাবে নরম হৃদয়ের অধিকারী হওয়া উচিত। সেজন্য বোধ-বিবেকের জানলা-দরজা খোলা রেখে মানুষের সাথে মেশা উচিত। অহেতুক কঠোরতা পরিত্যাজ্য। যে অন্তর কঠিন সেখানে রহমানের রহমতের ফেরেশতা অবস্থান করে না। কাউকে বিশ্বাস করা মানে জীবন-যৌবন অন্ধভাবে তার কাছে সমর্পণ করা নয়। যে জীবনের অংশ হবে সে মনুষ্যত্ব-মানবিকতা, বিশ্বাস-ভরসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় কি-না সেটা যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। সততার সাথে কোমল এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধ কঠোর অবস্থান- ঈমানের দাবি।
কিছু মানুষকে বাহির থেকে, কথা-স্বভাবে খুব কঠোর মনে হয়। কেমন একটা গুরুগম্ভীর ব্যাপার। তবে এই মানুষগুলোকে যদি একবার জয় করা যায় তবে এদের চেয়ে ভালো সঙ্গী আর কেউ হয় না। বাহিরের আস্তরণ যার যত মোটা ভেতরের পরত তার তত কুসুমকোমল। ভালো মানুষকে জানতে হয়, ভালো মানুষের সাথে মিশতে হয়। আবার যারা ফাঁদ পেতে জিহ্বার ডগায় মিষ্টি মিষ্টি বাক্য ঝুলিয়ে রাখে তাদের থেকে কয়েক যোজন দূরে থাকতে হবে। মানুষ কেন ঠকে? অন্ধ বিশ্বাস করে বলে। কারো সাথে ভালো আচরণ করলে, সুন্দরভাবে কথা বললেও যদি তার স্বভাব না বদলায় তবে পরিত্যাগের প্রতিজ্ঞা করুন। তাবৎ দুনিয়া জয় করার ভার দিয়ে আপনাকে প্রেরণ করা হয়নি। ভালোভাবে বাঁচার জন্য মাত্র কয়েকজন ভালো মানুষের সঙ্গ একজীবনের জন্য কাফি। অহেতুক কঠোরতা এবং যুক্তিহীন কোমলতা- দু'টোই স্বভাব ও সম্পর্কের ক্ষতিকারক দিক।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন