ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবসায়ী ‘টাইকুন’ প্রয়াত লতিফুর রহমানের অঢেল সম্পদই এখন তাঁর পরিবারে ‘গৃহবিবাদের’ কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রুপের ১৬টি প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছার এক পর্যায়ে লতিফুরের বড় ছেলে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের আকস্মিক মৃত্যু নতুন করে রহস্যের জন্ম দিয়েছে।
আর বড় মেয়ে সিমিন রহমান ও ছোট মেয়ে শাযরেহ হকের মধ্যে এখন রীতিমতো সাপে-নেউলে সম্পর্ক চলছে। অভিযোগ রয়েছে, বাবা লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর বড় মেয়ে সিমিন রহমান একে একে সব সম্পত্তি নিজের কবজায় নেওয়ার তৎপরতা চালান।
জাল দলিল ও নথিপত্র তৈরি করে সম্পত্তি জবরদখলের অপচেষ্টা করেন। তা জানার পর বড় ছেলে আরশাদ ওয়ালিউর রহমান তাঁর ছোট বোন শাযরেহ হককে আমমোক্তার করেন। এ ঘটনার মাত্র আট দিনের মাথায় নিজ বাসায় ‘অস্বাভাবিক’ভাবে মারা যান আরশাদ ওয়ালিউর রহমান। এরপর শাযরেহ হক এই মৃত্যু ঘিরে সন্দেহভাজন ১০ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
ওই মামলার পরই আরশাদ হকের মৃত্যুর রহস্য আরো দানা বাঁধতে থাকে। শাযরেহ হক বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পেছনে বড় বোন সিমিন রহমানের হাত থাকতে পারে বলে সন্দেহ করছেন। শাযরেহ হকের মামলার নথিপত্র ঘেঁটে এবং আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
এসব বিষয়ে শাযরেহ হকের আইনজীবী আমিনুল হক গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবারের সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দের মধ্যেই সিমিন রহমানের বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়েছে।
ভাইয়ের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি দাবি করে রাজধানীর গুলশান থানায় একটি হত্যা মামলা করেন সিমিন রহমানের ছোট বোন শাযরেহ হক।
পরে এই মামলা তদন্ত করে পিবিআই আদালতে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দেয়। তবে আদালত মামলা খারিজ করে দেওয়ায় তিনি এই আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশন আবেদন করেন। ওই আবেদনের গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে আগামী ৩০ জানুয়ারি শুনানির জন্য রাখা হয়েছে।’
ভাই হত্যার অভিযোগে সিমিন রহমানের বিরুদ্ধে মামলা
ভাই হত্যার অভিযোগে গত মার্চ মাসে ট্রান্সকম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সিমিন রহমানের বিরুদ্ধে রাজধানীর গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন ছোট বোন শাযরেহ হক।
ওই মামলায় আরো ১০ জনকে আসামি করা হয়।
সে সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার রিফাত রহমান শামীম কালের কণ্ঠকে মামলার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, ‘বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে হত্যার অভিযোগে ট্রান্সকম গ্রুপের পরিচালক শাযরেহ হক এই মামলা করেন।’
সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ১৬ জুন ঢাকার গুলশানের বাসায় নিজের শোয়ার ঘরে মৃত অবস্থায় আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে পাওয়া যায়। পরে হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছে বলে জানান।
ট্রান্সকম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর তাঁর পরিবারে শুরু হওয়া উত্তরাধিকারের লড়াইয়ের মধ্যে আরশাদের মৃত্যু হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও নানা প্রশ্নের জন্ম নিয়েছে। বড় বোনের বিরুদ্ধে বড় ভাই হত্যার অভিযোগ এনে ছোট বোন শাযরেহ হক যখন মামলা করেন, তখন বিষয়টি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে মামলার বিষয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়।
হত্যা মামলার আসামি করা হয় ট্রান্সকম গ্রুপের সিইও সিমিন রহমান, সিমিনের ছেলে ও ট্রান্সকম গ্রুপের হেড অব ট্রান্সফরমেশন যারাইফ আয়াত হোসেনকে। অন্য আসামিরা হলেন এসকেএফ ফার্মাসিটিউক্যাল লিমিটেডের ম্যানেজার (মেডিক্যাল অ্যাফেয়ার্স) ডা. মুরাদ, একই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক (মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস) ডা. মো. মুজাহিদুল ইসলাম, ট্রান্সকম লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স-আইন) মো. ফখরুজ্জামান ভূঁইয়া,
ট্রান্সকম গ্রুপ করপোরেট ফাইন্যান্সের পরিচালক মো. কামরুল হাসান, মো. জাহিদ হোসেন, ট্রান্সকম লিমিটেডের ম্যানেজার (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) সেলিনা সুলতানা, ট্রান্সকম লিমিটেডের ম্যানেজার (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) কে এইচ মো. শাহাদত হোসেন, বাবুর্চি রফিক এবং ব্যক্তিগত চালক মিরাজুল। এজাহারে ৭ নম্বর আসামি জাহিদ হোসেনের কোনো পরিচয় দেওয়া হয়নি।
মামলায় শাযরেহ হক অভিযোগ করেন, ‘পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অন্য ওয়ারিশ থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে কৌশলে বিষ প্রয়োগ/শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে বলে সিমিন রহমানসহ অন্যদের আচরণে প্রকাশ পাচ্ছে।’ মামলা করতে দেরি হওয়ার বিষয়ে এজাহারে বলা হয়, ‘নিকট আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে এজাহার দায়ের করতে বিলম্ব হইল।’
এর আগে কম্পানির সম্পত্তি ও শেয়ার সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে বড় বোনসহ অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেন শাযরেহ। তাতে আরো অনেককে আসামি করা হয়। ওই মামলায় বিশ্বাস ভঙ্গ, জালিয়াতি ও দলিল জালের মাধ্যমে শাযরেহ ও তাঁর প্রয়াত ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানকে ১০ হাজার কোটি টাকা মূল্যের পারিবারিক সম্পত্তির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করারও অভিযোগ করা হয়।
শাযরেহ অর্থ আত্মসাৎ, সম্পত্তি দখল ও অবৈধভাবে শেয়ার হস্তান্তরের অভিযোগ এনে তিনটি মামলা করেন, যেখানে আসামি করা হয়েছে তাঁর মা, বোন, ভাগ্নেসহ আটজনকে। ওই মামলায় ট্রান্সকমের পাঁচজন কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হন।
শাযরেহ হক তাঁর মামলায় বলেন, তাঁর বাবা লতিফুর রহমানের মৃত্যুর পর ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমান, বোন সিমিন রহমান এবং তিনি নিজে তাঁর বাবার সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী ওয়ারিশ। কিন্তু সিমিন রহমান এবং তাঁর ছেলে যারাইফ আয়াত হোসেন বিভিন্ন জাল কাগজপত্র তৈরি করে স্থাবর সকল সম্পত্তিসহ ট্রান্সকম গ্রুপের শেয়ার ও পজিশন থেকে তাঁকে এবং তাঁর ভাইকে বঞ্চিত করেন।
মামলায় আরো বলা হয়, ‘এ সকল বিষয় জানার পর বড় ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের সাথে কথা বলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সে প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ৮ জুন আরশাদ ওয়ালিউর রহমান আমাকে আমমোক্তারনামা দেয়।’
আরশাদ ওয়ালিউর ‘ডিভোর্সি এবং নিঃসন্তান’ ছিলেন—মামলায় এই তথ্য দিয়ে শাযরেহ হক বলেন, ‘আম মোক্তারনামা দেওয়ার কারণে সিমিন রহমান তার ভাইয়ের ওপর চরম ক্ষিপ্ত হয় এবং এ কারণে জীবনের নিরাপত্তার কথা নিকটজনের কাছে আরশাদ ওয়ালিউর রহমান বলেছিলেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই আমমোক্তারনামা দেওয়ার আট দিনের মাথায় ১৬ জুন পিতা লতিফুর রহমানের পুরনো গৃহকর্মী মোসলেম হাওলাদারের মাধ্যমে ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমান গুরুতর অসু্স্থ বলে জানতে পেরে ভাইয়ের গুলশানের বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে ভাইকে বিছানায় মৃত অবস্থায় দেখতে পাই, যেখানে আগে থেকে সিমিন রহমান, যারাইফ আয়াত হোসেনসহ মামলায় যাঁদের আসামি করা হয়েছে তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন।’
শাযরেহ হক মামলায় দাবি করেন, তাঁর ভাইয়ের অসুস্থতা এবং মৃত্যুর সংবাদ সেখানে উপস্থিত কেউ তাঁকে জানাননি। তা ছাড়া তাঁর ভাইয়ের কোনো জটিল রোগও ছিল না। এ ঘটনার তিন-চার দিন আগে থেকে তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে তিনি কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি বলেও মামলায় বলা হয়।
এতে আরো বলা হয়, সিমিন রহমান ভাই আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের মৃতদেহ হাসপাতালে নিয়ে মৃত্যুর সার্টিফিকেট তাড়াতাড়ি গ্রহণ করা এবং ওই দিনই বিকেলের মধ্যে দাফন করার জন্য সকলকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এর মধ্যে একটি অ্যাম্বুল্যান্সে করে মরদেহ ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়, সেখানে চিকিৎসক ‘কেন দেরি করে আনা হলো’ ‘অনেক আগেই মারা গেছেন’ বলে মন্তব্যও করেন। হাসপাতালে মৃত ঘোষণার পর হাসপাতালের চিকিৎসক আরশাদ ওয়ালিউর রহমানের শারীরিক অবস্থা কী ছিল, তাঁর কোনো দুরারোগ্য রোগ ছিল কি না জানতে চাইলে সঙ্গে থাকা ডা. মুরাদ নিজেকে তাঁর (আরশাদ ওয়ালিউর রহমান) ব্যক্তিগত চিকিৎসক হিসেবে দাবি করেন এবং তিনি ‘সমস্ত জানেন’ ‘কোনো পুলিশি রিপোর্ট প্রয়োজন নেই’ বলে জানান।
এরপর সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে ডা. মুরাদসহ সেখানে উপস্থিত কয়েকজন মরদেহ নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বজন ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা হবে না বলে জানানোর পর শাযরেহ হকের স্বামী ভগ্নিপতি হিসেবে লাশ গ্রহণ করেন বলে মামলায় বলা হয়।
জানা গেছে, লতিফুর রহমান মারা যাওয়ার পর তাঁর স্ত্রী শাহনাজ রহমান ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান হন। তাঁর বড় মেয়ে সিমিন রহমান গ্রুপের সিইও। আর নাতি যারেফ আয়াত ট্রান্সকমের হেড অব ট্রান্সফরমেশন। ছোট মেয়ে শাযরেহ হকও ট্রান্সকম গ্রুপের একজন পরিচালক।
আরশাদ ওয়ালিউরের মৃত্যুর পরপরই তাঁর বাড়ি, গাড়িসহ অন্যান্য সম্পত্তি সিমিন রহমান, যারাইফ আয়াত হোসেনসহ অন্যরা দখলে নিয়ে যান বলে মামলায় অভিযোগ করেন শাযরেহ হক।
জানা যায়, ২০২০ সালে লতিফুর রহমান মারা যাওয়ার পর ট্রান্সকমের বাংলাদেশ ল্যাম্পস, ট্রান্সকম ইলেকট্রনিকস, এসকেএফ ফার্মাসিউটিক্যালস ও পেপসিকোসহ গ্রুপটির ১৬টি বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এখন পুরোপুরি সিমিন রহমানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন