একটা নির্দিষ্ট সময় পর তোমার জমিদারি আর আমার ভিক্ষাবৃত্তি- কোনটাই আলাদা করে টিকবে না----
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
একটা নির্দিষ্ট সময় পর তোমার জমিদারি আর আমার ভিক্ষাবৃত্তি- কোনটাই আলাদা করে টিকবে না বরং একাকার হয়ে যাবে। শক্তি, ক্ষমতা, চেয়ার কিংবা দৃষ্টি- সময়ের নিয়ম মেনে সব হারিয়ে ফেলবো। তবে তোমার সাথে আমার আচরণ কেমন ছিল- দুর্বল মস্তিষ্ক তখনও তা একটু একটু মনে রাখবে। ধাক্কা দিয়েছিলে নাকি বুকে নিয়েছিল- স্মৃতিচারণে সেসব আলোচনাও বাদ যাবে না। যখন দু'জনেই প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পড়বো তখন ক্ষমতাবান-সম্পদশালী মানুষের চেয়ে ভালো মানুষের সঙ্গ বেশি দরকার পড়বে। অবৈধ অর্থ, লোক ঠকানো ক্ষমতায় যদি উত্তরসূরি রেখে যাই তা দিয়ে আসলে কোন উপকার হবে না বরং অপকার বাড়বে। ভালো আচরণের উত্তরাধিকার রাখতে পারলে মানুষ সহস্র বছর বাঁচতে পারে!
মানুষ দু'টো সময় শিশু থাকে- তাঁর শৈশবে এবং বার্ধক্যে। মাঝের সময়টা আঁকাবাঁকা পথচলা। এই সময়টা সমস্ত আয়ুর বড়জোর অর্ধেক হতে পারে; বেশি নয়। এই সময়টাতে কেউ ক্ষমতাধর হবে আবার কেউ ক্ষমতাহীন রবে, কেউ অর্থবিত্তের মালিক হবে আবার কেউ পথের ফকির হালে থাকবে, কেউ রাজসভা পাবে আবার কেউ বনবাসে মৃত্যুর প্রহর গুণবে কিংবা কারো সময়টা ভালো যাবে আবার কেউ খাঁটি দুঃখ পাবে- যিনি যেমন সময়ের স্বাক্ষী হোক- তিনি যেন সবসময় মনে রাখেন- এটা তার পরীক্ষাকাল; এ-র বেশি কিছুই না। ক্ষমতা, চেয়ার জোর করেও দখল করা যায়, দম্ভ-ভোগে জীবন কাটানো যায় কিন্তু কিছুই যে ধরে রাখা যায় না! যে মানুষকে স্রষ্টা দুর্বল করে সৃষ্টি করেছেন সেই মানুষ পাথরের মত শক্ত হবে না! তবে ধৈর্য ধরলে পাথরের চেয়েও শক্ত কিছু প্রজ্ঞা দিয়ে কাটতে পারবে! বালি দিয়েও অনেক কিছু গড়তে পারবে! কাজেই ভালো মানুষ হওয়ার চিরন্তন আহ্বান যাতে কোনদিন অবজ্ঞা না করি।
আজ কে আমির আর ফকির, কে চেয়ারে আর কে মাদুরে কিংবা যিনি বসার জন্য আসন পায়নি- তা মানুষ ঠিক করতে পারে না। কাউকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে আবার কেউ অমেধাবী- তাই বলে মেধাহীনদের বিষয়ে মেধাবীদের তাচ্ছিল্য-অপমান করার অধিকার দেওয়া হয়নি। আমি বুদ্ধিমান, আমি বেশি জানি- এই বোধ মনের মধ্যে অহংকারের জন্ম দেয়। যার অহংকার যত বাড়ে তার পতন তত গভীরে হয়। সম্পদ পেয়ে, চেয়ারে বসে কিংবা ক্ষমতালাভ করেও যারা মানুষ থাকতে পেরেছে তারা মানুষের ভালোবাসা পায়-পেয়েছে। তাদের আসন হয় মানুষের মনের মধ্যে। যারা অভিশাপের আঙিনা থেকে সম্পদ কুড়োয়- তাদের বাহাদুরি ধ্বংস হওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। কত দাম্ভিক দুনিয়া ছেড়ে যাওয়ার সময় ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নবতে পারেনি। অতীতেও সেটা হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।
যে যত বিনয়ী সে তত বড়। আত্ম-অহমিকা অযোগ্যতার অস্ত্র। এই অস্ত্রের অপব্যবহারে তারা মানুষকে আঘাত করে, ব্যথা দেয় এবং গণসম্পদের খেয়ানত করে। যারা মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ণ করতে জানে না তারা লম্বায় কত উঁচু, পদে কত বড় কিংবা ক্ষমতায় কত ব্যাপৃত- তাতে আসলে প্রকৃত মানুষের কিছুই আসে যায় না। অত্যাচারী আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে, অন্যায়ভাবে সাময়িক ক্ষতি করতে পারে কিংবা জনপদকে ভীত-সন্ত্রস্ত রাখতে পারে কিন্তু মানুষের থেকে সম্মান আদায় করতে পারে না। ভয় আর সম্মান আলাদা চরিত্রের- এটা তাতের বোঝা উচিত। যাদের কাছে সম্মানের চাইতে সম্পদ বড়- আলোকিত মানুষদের তাদের সাথে বিতর্কের আসরে বসা খাটে না। কখনো কখনো মুর্খের আলাপ শোনা জ্ঞানের সদকাহ!
মানুষের সাথে মানুষ পরিচয়ে আচরণ করা উচিত। কেউ ছোট কাজ করে কিংবা কিছুই করে না- তাকেও অপমান-অপদস্থ করার অধিকার কেউ রাখে না। পরীক্ষার নম্বর পাশ-ফেল নির্ধারণ করতে পারে, এতে অবস্থান-অপমান নিশ্চিত হতে পারে কিন্তু ভালো মানুষের পরীক্ষায় কে উৎরে যাবে তা সময় নির্ধারণ করে। জীবনের আসল সম্পদ অর্থকড়ি নয় বরং কোমলতা-বিনয়।যে ভূমি তোমার-আমার থাকবে না- সেখানে সীমিত সময়ের জন্য মস্ত অধিকার পেয়ে আজন্মের মালিকানার বৃক্ষরোপণ করে যাওয়া অন্যায়। হিংসা ছড়িয়ে গেলে সেটাও বাড়ে। তবে ঘৃণার পথ থেকে বিরত থাকা উচিত। ভালোবাসা বিছিয়ে দাও- সেটাও বাড়বে, সুঘ্রাণ-সুবাতাস ছড়াবে। পাছে কিছু রেখে যেতে হলে ভালো আচরণ, বিনয় এবং সৎগুণগুলো পরম যত্নে রেখে যাওয়াই শ্রেয়। শত্রুতা পুষে রেখে কেউ বড় হতে পারে না কিংবা পারে নি। একদিন কেউ তাদের পূর্বের স্থানে থাকবো না, এমনকি পরবর্তী স্থানেও! আমাদের ঠাঁই হবে বিস্মৃতির পাতায়- যদি মানুষের জন্য অর্পিত দায়িত্বটুকু পালন না করি। মানুষের অধিকার অন্যায়ভাবে দখলে রাখলে- সময় বিনিময় দেবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন