সুইডিশ ভাষায় ‘ফেস্ট’ শব্দের ইংরেজি অর্থ ‘পার্টি’, আর বাংলা ভাষায় ‘পার্টি’ শব্দটি বেশ পরিচিত। ইউরোপের পার্টি, বিশেষ করে সুইডিশ পার্টির ওপর কিছু তথ্য আজ তুলে ধরব। জানুয়ারি মাস বছরের প্রথম মাস। সব কিছুতে নতুনত্বের অনুভূতি থাকে, যার কারণে মাসটি দ্রুত চলে যায়। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে, সুইডেনে ‘স্পোর্টলোভ’ বা শীতকালীন ছুটি উদযাপিত হয় এক সপ্তাহ ধরে।
এ সময় স্কুল বন্ধ থাকে এবং ছোট-বড় সবাই তুষারে স্কিইং থেকে শুরু করে স্কেটিং পর্যন্ত বিভিন্ন অ্যাকটিভিটিতে অংশ নেয়। এই অ্যাকটিভিটিগুলো বেশিরভাগই পার্টির মধ্যে পড়ে, যেমন একসঙ্গে স্কী করা, সাওনাতে গরম এবং ঠান্ডা পরিবেশে গোসল করা, তুষারের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করা, একসঙ্গে ডিনার করা—এগুলো ছোট-বড় সবার জন্য একটি আনন্দময় বিশেষ সময় হয়ে থাকে।
মার্চ মাসে সাধারণত তেমন কোনো উৎসব হয় না, তবে এপ্রিলে যিশুখ্রিস্টের পুনরুত্থান তথা অলৌকিক ঘটনাটিকে স্মরণ করার জন্য ইস্টার উৎসব উদযাপিত হয়। এটি খ্রিষ্টীয় বর্ষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি পুরাতন জীবন অবসানের পর নতুন জীবন শুরুর প্রতীক। এ সময় স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে। অনেকেই এই ছুটিতে সুইডেন বা ইউরোপের বাইরে গরমের দেশে সময় কাটাতে পছন্দ করে।
এপ্রিলের শেষের দিন বা মে মাসের প্রথম দিনে ‘Valborgsmässoafton’ পালিত হয়। শীত বিদায় দিতে জঙ্গলের কাঠ জমা করে আগুন জ্বালানো হয়, আর সঙ্গে থাকে নাচগান ও হৈহুল্লোড়। সুইডিশ জাতি দিনটি পালন করে আনন্দের সাথে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ধরনের অনুষ্ঠান বা পার্টি হয় এবং ডরমিটরির ফেস্ট বা ডরমিটরি পার্টি শিক্ষার্থীদের জন্য মজাদার সময় হয়ে থাকে।
জুন মাসে সুইডেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্টি হলো মিডসামার পার্টি। এই সময় সুইডিশরা বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন, বাড়িতে ফিরে আসে। সবাই মিলে আনন্দ-ফুর্তি, নাচ-গান, ভালো খাবার, প্রচুর ড্রিঙ্কসহ দিনটি উদযাপন করে। এটি একটি ব্যতিক্রমী ট্র্যাডিশন বলা যেতে পারে। সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে তারা ‘হোস্ট পার্টি’ বা ‘অক্টোবর পার্টি’ পালন করে। জার্মানিতে প্রতি সপ্তাহে বিশাল পার্টি হয়, যা দেখতে এবং এতে যোগ দিতে পৃথিবীর নানা দেশের লোকজন ভিড় করে।
সুইডেনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় পার্টি হয় ১০ ডিসেম্বর, আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে। যদিও এটি একটি মৃত্যুবার্ষিকী, তবে দিনটি পালিত হয় আনন্দ-ফুর্তির মধ্য দিয়ে। কারণ, সারা পৃথিবী থেকে সেরা ব্যক্তিরা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে নোবেল পুরস্কারের জন্য সম্মানিত করা হয়। নোবেল পুরস্কারকে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানজনক পদক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ডিসেম্বর মাসেই খ্রিষ্টানদের বড়দিন উদযাপিত হয় এবং সুইডেনে বড়দিন পালনের সময়টি বেশ আনন্দময়।
বড়দিন পালনের পরপরই শুরু হয় নতুন বছরকে বরণ করার প্রস্তুতি। নববর্ষ উদযাপন বা দিনটিকে বিদায় দিয়ে নতুন বছরের প্রথম দিনকে বরণ করার জন্য নানা অনুষ্ঠান হয়। দিনের শেষে সুইডেনের শীতের দেশে, ঘরে-বাইরে সবাই অপেক্ষায় থাকে— কখন ঘড়ির কাটায় রাত বারোটা বাজবে, কখন ঘণ্টা বাজবে, আর কখন শ্যাম্পেনের বোতল খুলে নববর্ষ দিবসে চিয়ার্স বলতে হবে, সেই প্রতীক্ষায় আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা।
হঠাৎ যখন সেই মুহূর্তটি এসে পৌঁছাবে, তখন ডিস্কোটেকের বিখ্যাত আব্বা গান বাজতে শুরু করবে, আর বন্ধু তার বান্ধবী, প্রিয় তার প্রিয়াকে, স্বামী তার স্ত্রীর গা জড়িয়ে ধরবে এবং গাইতে শুরু করবে—
‘No more champagne / Here we are, me and you / Feeling lost and feeling blue / It’s the end of the party / And the morning seems so grey / So unlike yesterday / Now’s the time for us to say — Happy New Year’।
বিদায়ী বছর: সুখ-দুঃখের মিশ্র অভিজ্ঞতা
২০২৪ সালে কিছু অর্জন ও ব্যর্থতা, দুটোই ছিল। তবে, সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল মহামারি-পরবর্তী জীবনযাত্রা। সুইডেনে বসবাসকারী হিসেবে, আমি লক্ষ্য করেছি কীভাবে মানুষ একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠন করেছে এবং কীভাবে সবাই তাদের জীবনে স্থিতি আনার চেষ্টা করছে। কাজ, সম্পর্ক এবং দিনশেষে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার জন্য এক কঠিন লড়াই ছিল।
ভালো দিকগুলো
• সম্পর্ক পুনর্গঠন: মহামারির পরে আমি দেখেছি অনেক মানুষ হারিয়ে যাওয়া সম্পর্কগুলো নতুন করে গড়তে চেষ্টা করেছে। পরিবার এবং বন্ধুবান্ধবদের প্রতি আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
• কাজে সাফল্য: আমি নিজে কাজের জায়গায় নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সাফল্য পেয়েছি। ক্যারিয়ারে উন্নতি এবং নিজের দক্ষতা আরও বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেছি।
• পরিবেশ সচেতনতা: জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশ রক্ষায় আলোচনা বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি, আমি নিজেও বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি।
মন্দ দিকগুলো
• মানসিক চাপ ও উদ্বেগ: সুইডেনে, দ্রুতগতির জীবনযাত্রা এবং কর্মক্ষেত্রে চাপ আমাকে একাধিকবার মানসিকভাবে ক্লান্ত করেছে।
• আর্থিক চ্যালেঞ্জ: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব আমার জীবনেও পড়েছে। এর ফলে বেশ কিছু আর্থিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
• বিশ্বজুড়ে সংঘাত: বিশ্বের নানা অংশে সংঘাত, অস্থিরতা এবং উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে, যা আমাদের সমাজের শান্তির জন্য হুমকি।
বছরটি আরও ভালোভাবে কাটানো যেত যদি…
• আমরা জীবনের ছোট মুহূর্তগুলোকে উদযাপন করতে পারতাম।
• সময় ব্যবস্থাপনায় আরও দক্ষ হতে পারতাম।
• প্রযুক্তির অপব্যবহার না করে প্রকৃতির সাথে সময় কাটাতাম।
• সহযোগিতা এবং সহমর্মিতা বাড়াতাম।
নতুন বছর: আশার আলো এবং পরিকল্পনা
নতুন বছর আমাদের একটি নতুন সূচনা দেয়। আমি বিশ্বাস করি ২০২৫ সালে আরও অনেক অর্জন এবং প্রত্যাশা পূরণের সুযোগ পাবো। সুইডেনে থাকার অভিজ্ঞতায়, আমি বুঝেছি যে আমাদের জীবনে নতুন বছরকে স্বাগত জানানো শুধু একটি পালাবদল নয়, এটি জীবনের নতুন শুরু।
কীভাবে কাটবে নতুন বছর
১. সচেতন জীবনযাপন: প্রতিদিনের সুখগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে উপভোগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
২. স্বাস্থ্য ও মানসিক উন্নয়ন: নতুন বছরে শরীরচর্চা এবং মানসিক শান্তি নিয়ে আরও সচেতন হতে চাই।
৩. পেশাগত উন্নয়ন: আমি নতুন কিছু শেখার এবং দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে মনোনিবেশ করতে চাই।
৪. সামাজিক উন্নয়ন: পরিবেশ রক্ষা এবং কমিউনিটির উন্নয়নে আরও কাজ করতে চাই।
৫. পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো: সম্পর্কগুলো আরও গভীর করতে চাই।
৩১ ডিসেম্বর সুইডেনে নববর্ষের উদযাপন একটি বিশেষ দিন। এই দিনটি আমার কাছে শুধু একটি দিন নয়, এটি সকল কঠিন সময়ের শেষে আনন্দের এক মুহূর্ত। সুইডেনের বন্ধুদের সঙ্গে এটি কাটানোর অভিজ্ঞতা প্রতিটি মুহূর্তেই আনন্দদায়ক।
পরিকল্পনা:
• পরিবার ও বন্ধুদের সাথে ঘরোয়া পার্টি।
• বন্ধুদের সঙ্গে খাওয়া-দাওয়া ও আড্ডা।
• আতশবাজি আর আলোর মধ্য দিয়ে রাতের আকাশে নতুন বছরের প্রতীক্ষা।
• পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ এবং নতুন বছরের জন্য প্রতিজ্ঞা করা।
বড় পরিকল্পনা:
• শহরের বড় উৎসবে অংশগ্রহণ।
• শীতবস্ত্র বিতরণ এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে সাহায্য করা।
• নিজের এবং অন্যদের জন্য একটি “বেটার লাইফ প্ল্যান” তৈরি করা।
স্মৃতি থেকে শিক্ষা এবং ভবিষ্যতের প্রস্তুতি
২০২৪ আমাকে শিখিয়েছে যে জীবনে সব কিছু পূর্বনির্ধারিত নয়, তবে নিজের চেষ্টার মাধ্যমে আমরা সব বাধা কাটিয়ে যেতে পারি।
যা যা শিক্ষণীয়
• সুখের জন্য নিজেকে আত্মবিশ্বাসী এবং নির্ভরশীল হতে হবে।
• সময়কে সঠিকভাবে ব্যবহারের গুরুত্ব আমি অনুভব করেছি।
• ব্যর্থতা জীবনের অংশ, তবে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও শক্তিশালী হওয়া যায়।
একটি নতুন দিগন্তের সূচনা
২০২৫ সাল আমাদের সবার জন্য একটি নতুন দিগন্ত, নতুন সুযোগ এবং স্বপ্ন নিয়ে আসুক। সুইডেনে কাটানো সময় আমাকে শিখিয়েছে যে, একে অপরের সহযোগিতা এবং ভালোবাসা ছাড়া জীবন চলতে পারে না। আমরা সবাই মিলে এই নতুন বছরের পথচলা শুরু করবো এবং বিশ্বে শান্তি এবং সমৃদ্ধি আনতে একে অপরের পাশে দাঁড়াবো।
এভাবেই বিদায় হবে ২০২৪, তুমি আর থাকব না, তোমার সঙ্গে আমরা চলব না। কী দিয়েছি বা দেয়নি, সে বিষয়ে আর ভাবনা নেই। রাত কখন শেষ হয়ে সকাল হবে, সে চিন্তা থাকে না। কখন, কে, কোথায় এবং কীভাবে ঘুমিয়ে আছে—তার আর কিছু জানার প্রয়োজন নেই।
১ জানুয়ারি সুইডেনে ছুটির দিন। ২ জানুয়ারি সকালে ঘুম থেকে উঠে কাজে যেতে হবে। কী প্রত্যাশা হ্যালো ২০২৫, তোমার থেকে? পুরোনো ২০২৪ সালকে পেছনে ফেলে, নতুন বছর নতুন প্রত্যাশায় এগিয়ে যাবে। আমরা সবাই একত্র হয়ে বিশ্ব ফোরামের বন্ধুরা নতুন দিগন্তের দ্বার খুলে দেবো, শুভ ও মুক্ত চিন্তায়, নতুন বছরের প্রত্যাশায়। একটি শান্তিপূর্ণ এবং স্বস্তিপূর্ণ সময়, একটি দুর্নীতি ও অনীতিমুক্ত সমাজ, একটি সুস্থ ও অভাবমুক্ত জীবনের নতুন পথচলা হোক আমাদের সকলের প্রত্যাশা। সেই সাথে স্বাগতম নতুন ইংরেজি নববর্ষ ২০২৫। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা, অভিনন্দন এবং ভালোবাসা জানাচ্ছি।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন