জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) নতুন বছরের প্রথম দিন শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিন দু-তিনটি বই তুলে দিতে নানা পরিকল্পনা করেছিল এনসিটিবি। কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনাও সফল হয়নি। কোন শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কবে বই পাবে, তা জানাতে পারছে না স্কুলগুলো।
এত দিন বছরের প্রথম দিন বই উৎসব অনেকটা সর্বজনীন উৎসবের মতো ছিল। এ বছর বই ছাপতে দেরি হওয়ায় হচ্ছে না সেই উৎসব।
আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে এনসিটিবি সব বইয়ের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও তা শেষ করতে ফেব্রুয়ারি মাসের পুরোটা লাগতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে পাঠ্যবইয়ের অনলাইন ভার্সন উদ্বোধন করবেন শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
তবে এই অনলাইন বই ডাউনলোড করে শিক্ষার্থীদের পক্ষে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এনসিটিবি সূত্র জানায়, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বেশির ভাগ বই এরই মধ্যে ছাপা হয়েছে এবং তা উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ফলে এই তিন শ্রেণির বেশির ভাগ শিক্ষার্থী বছরের প্রথম দিন বই পাবে। তবে অন্যান্য শ্রেণির কত শতাংশ বই ছাপা হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণির বই বেশির ভাগ স্কুলই পায়নি। তবে রাজধানী, বিভাগীয় ও জেলা শহরের কিছু স্কুলে কয়েকটি শ্রেণির তিনটি বিষয়ের স্বল্পসংখ্যক বই তারা পেয়েছে। কিন্তু এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে পাঠানো বই কিভাবে স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের হাতে দেবে, তা তারা বুঝতে পারছে না। তারা আরো বই পাওয়ার অপেক্ষা করছে।
মফস্বল ও দূরের স্কুলগুলো চতুর্থ থেকে দশম শ্রেণির কোনো বই পায়নি।
এতে স্কুলগুলো শিক্ষার্থীদের জানাতে পারছে না কবে তারা তাদের হাতে বই তুলে দিতে পারবে।
জানতে চাইলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রিয়াজুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ প্রায় শেষ এবং উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছেও গেছে। অন্যান্য শ্রেণির কিছু না কিছু বই আমরা প্রতিটি উপজেলায় পাঠাতে চেষ্টা করেছি। ১ জানুয়ারি আমরা ৪৫৫টি বইয়ের অনলাইন ভার্সন উদ্বোধন করছি। আগামী ২০ জানুয়ারির মধ্যে আমরা সব বই উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি।’
সূত্র জানায়, সংগত কারণেই এ বছরের বইয়ের পাণ্ডুলিপি প্রণয়নে দেরি হয়েছে। তারপর আবার দরপত্রসহ নানা প্রক্রিয়া শেষ করতেও দেরি হয়েছে। ফলে আগে থেকে সংশ্লিষ্ট সবাই আশঙ্কা করেন, এবার বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই তুলে দেওয়া সম্ভব হবে না। এ জন্য শিক্ষার্থীরা যাতে অন্তত তিনটি করে বই পায়, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলা হয়। কিন্তু এনসিটিবি সেসব কথায় গুরুত্ব না দিয়ে তাদের মতো চলতে থাকে। যদিও শেষের দিকে এসে তিনটি করে বই দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এমনকি প্রেস মালিকদের চাপ দিতে থাকে। কিন্তু বছরের শেষ দিনে এসে এনসিটিবির সব পরিকল্পনাই ব্যর্থ হয়।
শিক্ষকরা বলছেন, গত দুই বছর নতুন শিক্ষাক্রমে পড়ালেখা করেছে শিক্ষার্থীরা। সেখানে ভিন্নধর্মী পড়ালেখায় শিক্ষার্থীদের তেমন কোনো চাপ নিতে হয়নি। কিন্তু এখন হঠাৎ করেই আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যেতে হয়েছে। এতে এমনিতেই বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থী তাল মেলাতে পারছে না। তারা এ বছরের বার্ষিক পরীক্ষায় খুব খারাপ করেছে। এখন যদি আবার বই পেতে পেতে আরো দুই মাস চলে যায়, তাহলে বড় ধরনের শিখন ঘাটতিতে পড়বে শিক্ষার্থীরা।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, এবার প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীসংখ্যা চার কোটি ৩৪ লাখ তিন হাজার ২৮৩। তাদের জন্য ছাপা হচ্ছে ৪০ কোটি ১৫ লাখ ৬৭ হাজার ২০২ কপি বই। প্রাথমিকের দুই কোটি ৯ লাখ ৪৪ হাজার ৪৭৯ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপা হচ্ছে ৯ কোটি ১৯ লাখ ৫৪ হাজার ৩৫৫টি বই। মাধ্যমিক পর্যায়ের দুই কোটি ২৪ লাখ ৫৮ হাজার ৮০৪ জন শিক্ষার্থীর জন্য ছাপানো হচ্ছে ৩০ কোটি ৯৬ লাখ ১২ হাজার ৮৪৭ কপি বই। এ ছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য সাড়ে আট হাজারের বেশি ব্রেইল বই ছাপা হচ্ছে। শিক্ষকদের জন্য প্রায় ৪১ লাখ সহায়িকা ছাপা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণির বই ছাপার কাজ বেশ আগেই শুরু হয়েছে। এই বইয়ের সংখ্যা প্রায় পাঁচ কোটি। এরপর ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির কার্যাদেশ ও চুক্তিপত্র শেষে দুই সপ্তাহ আগে তা ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। এই বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১২ কোটি। গত সপ্তাহের শেষ দিকে চতুর্থ, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির বইয়ের ছাপা শুরু হয়েছে। এ সপ্তাহে নবম ও দশম শ্রেণির বই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। তবে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এক বছর বই পড়ে এসএসসি পরীক্ষায় বসবে বলে তাদের বইয়ের কাজ আগে শেষ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
প্রেস মালিকরা বলছেন, আমাদের প্রেসের প্রতিদিন দুই লাখ বই ছাপার সক্ষমতা। আমরা শত চেষ্টা করেও এর বেশি বই ছাপতে পারব না। কিন্তু এনসিটিবি একসঙ্গে সব বইয়ের কার্যাদেশ দিয়ে সব বইয়ের ছাপার কাজ শেষ করতে বলছে। তারা ব্যাপারটি বুঝেও না বোঝার ভান করছে। আগে প্রতিটি শ্রেণির বইয়ের কার্যাদেশ পর্যায়ক্রমে দেওয়া হতো। এতে একটি শ্রেণির বইয়ের কাজ শেষ করে আরেকটি ধরা যেত। কিন্তু এবার তা না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বই দিতে দেরি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রতিবছর সাধারণত জুলাই-আগস্ট থেকে পাঠ্যবই ছাপার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এর পরও ডিসেম্বরের মধ্যে শতভাগ বই দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এনসিটিবিতে অনেক পরিবর্তন আসে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, সদস্য ও অন্য কর্মকর্তারা পরিবর্তন হন। এরপর আবার আগের শিক্ষাক্রমে ফিরে যাওয়া হয়। পাঠ্যক্রমেও বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে পাণ্ডুলিপি পরিমার্জনেও বেশ সময় লাগে। এরপর আবার এনসিটিবির নতুন কর্মকর্তাদের দক্ষতা ও পরিকল্পনার অভাবে পাঠ্যবইয়ের কাজ বেশ কিছুটা পিছিয়ে যায়।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন