জন্মের এক বা দু’বছর পর, এমনকি কোনও কোনও সময় মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই মেয়েদের বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেন তার মা-বাবা। যে পরিবারে যত বেশি অর্থের প্রয়োজন সেই পরিবারে তত তাড়াতাড়ি মেয়েদের বাগদান সম্পন্ন করে ফেলা হয়। এমনই ঘটনা ঘটে ভারতের মধ্যপ্রদেশের রাজগড় জেলার প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ভারতে বাল্যবিবাহ নিষিদ্ধ হলেও এই আইনের বিন্দুমাত্র প্রভাব পড়েনি।
স্বাধীনতার ৭৭ বছর অতিক্রান্ত হলেও মধ্যপ্রদেশের রাজগড় জেলার দুর্গম ভূখণ্ডে তার আঁচও লাগেনি।
এই অঞ্চলে একটি মেয়ে জন্ম নেওয়ার পরই তাদের পায়ে পরানো হয় এক সামাজিক বেড়ি, যা এখানকার নারীদের বয়ে নিয়ে চলতে হয় আমৃত্যু। সময়ের অনেক আগেই যৌবন ফুরিয়ে যায় এখানকার মেয়েদের।
বাল্যবিবাহের মতো প্রাচীন প্রথা এখনও পুরোদস্তুর পালন করা হয় এই জেলার জৈতপুরা গ্রামে।
শুধু এই গ্রামটিই নয়, আরও ৫০টি গ্রাম রয়েছে যেখানে জন্মের প্রায় পরপরই মেয়েদের বিয়ে ঠিক করে ফেলা হয়। শৈশবের পুতুলখেলার বয়সে বালিকা ও কিশোরীদের বসিয়ে দেওয়া হয় বিয়ের পিঁড়িতে।
দারিদ্র ও হতাশা থেকে মুক্তি পেতে পরিবারের মেয়েদের শৈশবকেই বলি দেয় পরিবারের সদস্যেরা। বাল্যবিবাহের মতো ‘সামাজিক প্রথা’ এখানে চলে আসছে যুগের পর যুগ।
এই অচলায়তন ভেঙে বেরিয়ে আসা তো দূরের কথা, এই নিয়মের চোরাবালিতে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে সবগুলো পরিবার। প্রায় ৭০০ মেয়ের জীবনে নেমে এসেছে ‘বিয়ে’ নামক অভিশাপ।
এই গ্রামের নারীরা গর্ভবতী হলে পরিবারের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়ে যায়। যদি গর্ভস্থ সন্তান মেয়ে হয় আর প্রতিবেশীর বাড়িতে যদি ছেলে সন্তান থাকে, তাহলে তাদের বিয়ে ঠিক করে দেওয়া হয় সেই সময়ই। অনেক সময় বাড়ির পুরুষেরা মত্ত অবস্থায় থাকাকালীন বাড়ির সন্তানদের বিয়ে ঠিক করে ফেলেন।
দুই বছরের মধ্যে বাগ্দান আর ১৮ বছরের আগেই বিয়ে সেরে ফেলতে হয় এই গ্রামের নারী-পুরুষকে। নারীদের মতো পুরুষকেও নিয়মের বাঁধনে আটকে পড়তে হয়। চাইলেও এই বাগদান ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারেন না তারা। কেউ বিয়ে ভাঙতে চাইলে তাদের বড়সড় জরিমানার মুখে পড়তে হয়।
গ্রামের বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সি নারী রমা সংবাদমাধ্যমে জানান, মাত্র ১০ বছর বয়সেই তার শৈশবের মেয়াদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। গীতা নামে আরেক তরুণী, এখন যার ২২ বছর বয়স, তার বাগদান হয়েছিল দুই বছর বয়সে, ষোড়শী হওয়ার পরই বিয়ে। গীতা এখন দুই সন্তানের জননী।
শুধু মেয়েরাই যে একা নিপীড়িত হচ্ছেন এমনটা নয়। একই দশা গ্রামের ছেলেদেরও। দিনেশ নামে এক নাবালক জানায়, বাগদানের সময় তার হবু স্ত্রীকে একটি অলঙ্কার এবং একটি লকেট পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া হয়েছিল। ১০ বছরের এক বালক জানায়, “মিষ্টির হাড়ি দিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। আমি এখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। আমি এখনই বিয়ে করতে চাই না। আমি বড় হয়ে ডাক্তার হতে চাই।”
৮-১০ বছর বয়সি মেয়েরা জানায়, বিয়ে ও বাগদানের সময় তাদের হাতে ও পায়ের যে ভারী ভারী গয়নাগুলো দেওয়া হয় সেগুলো তারা পরতে চায় না। প্রতিদিন বাবা-মাকে বলা সত্ত্বেও এগুলো থেকে মুক্তি মেলে না তাদের। তাদের বলা হয় এগুলো পরতে হবে। এটা বন্ধন।
যুক্তি গ্রামের প্রধান গোবর্ধন তনওয়ার বলেন, ঋণ এবং বিয়ের খরচ থেকে মুক্তি পেতে এই রীতি অনুসরণ করা হয়। অনেক ক্ষেত্রে অভিভাবকেরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় সন্তানদের বিয়ে ঠিক করেন। তারা টাকা ধার করে তাদের মেয়েদের বিয়ে দেন। এভাবেই চলতে থাকে।
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা অনুযায়ী, রাজগড়ের ২০-২৪ বছর বয়সি ৪৬ শতাংশ নারীর সাবালক হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। অর্ধেকেরও বেশি নারী নিরক্ষর। এই প্রথা ভাঙলে পরিবারগুলোকে মোটা জরিমানা দিতে হয়। এমনকি পঞ্চায়েতের সামনে হাজির হয়ে জবাবদিহিও করতে হয়।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন