শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানো প্রশ্নে মুখ খুলছে না ভারত

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানো প্রশ্নে মুখ খুলছে না ভারত। বাংলাদেশ থেকে চিঠি পাওয়ার কথাই শুধু স্বীকার করছে দেশটি। গতকাল শুক্রবার নয়াদিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ের শুরুতেই প্রশ্ন ওঠে শেখ হাসিনা প্রসঙ্গে।

একজন সাংবাদিক শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে বাংলাদেশের অনুরোধের বিষয়ে জানতে চান।

জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, ‘এক সপ্তাহ আগে আমি নিশ্চিত করেছিলাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপারে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে একটি বার্তা পেয়েছিলাম। এর বাইরে এ পর্যায়ে আমার আর কিছু বলার নেই।’

 

এর আগে গত ২৩ ডিসেম্বর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের জানান, বিচারের মুখোমুখি করতে শেখ হাসিনাকে ভারতের কাছে ফেরত চেয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘নোট ভারবাল’ (কূটনৈতিক বার্তা) দিয়ে ভারত সরকারকে বাংলাদেশ জানিয়েছে।

 

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল সেদিনই ভারতীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা নিশ্চিত করছি, প্রত্যর্পণের অনুরোধসংক্রান্ত একটি কূটনৈতিক বার্তা আজ (২৩ ডিসেম্বর) নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে পেয়েছি। এই পর্যায়ে এ বিষয়ে আমাদের আর কোনো মন্তব্য নেই।’

ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন দুপুরেই ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা।

এরপর একাধিকবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেছেন, নিরাপত্তাজনিত কারণে শেখ হাসিনা ভারতে গেছেন। একই কারণে শেখ হাসিনা সেখানে আছেন।

 

এদিকে সরকারের পতনের পর শেখ হাসিনাসহ তাঁর সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক মিত্রদের বিরুদ্ধে গুম, খুন, আটক, নির্যাতন, হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সারা দেশে মামলা দায়েরের হিড়িক পড়ে। অন্তর্বর্তী সরকার এসব অপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার সিদ্ধান্ত নিলে সেখানেও অভিযোগ জমা পড়ে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন মিলিয়ে দেড় শরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে।

বেশির ভাগ অভিযোগে শেখ হাসিনার নাম রয়েছে। এর মধ্যে গত ১৭ অক্টোবর প্রসিকিউশনের আবেদনে শেখ হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর ২৭ অক্টোবর সেনা ও পুলিশের সাবেক ১৭ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর চিফ প্রসিকিউটরের কার্যালয় শেখ হাসিনাকে ধরতে ‘ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি)’ মাধ্যমে ইন্টারপোলকে চিঠি দেয়।

 

বাংলাদেশ-ভারত বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাওয়ার আশা করছে বাংলাদেশ। ২০১৩ সালে ওই চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ ও ভারত। ওই চুক্তির আওতায় আসামের স্বাধীনতাকামী সংগঠন উলফার শীর্ষ নেতা অনুপ চেটিয়াসহ কয়েকজনকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রত্যর্পণ করা হয়েছিল।

চুক্তিতে বলা হয়েছে, ন্যূনতম এক বছরের সাজা হতে পারে এমন মামলায় আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেই ভারত বা বাংলাদেশকে পলাতক বন্দি হস্তান্তর করতে পারবে। তবে যদি অপরাধ রাজনৈতিক হয়, তবে প্রত্যর্পণের অনুরোধ অপরপক্ষ প্রত্যাখ্যান করতে পারবে।

গত ২৮ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলার ওয়েবসাইটে ‘শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ঢাকার অনুরোধকে কেন গুরুত্ব দিচ্ছে না ভারত’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়, ‘‘বস্তুত ভারত সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র দিল্লিতে বিবিসি বাংলাকে আভাস দিয়েছে, তারা এই অনুরোধকে আদৌ খুব একটা আমল দিচ্ছে না। এমনকি বাংলাদেশ সরকারও যে খুব একটা ‘সিরিয়াসনেস’ বা গুরুত্বের সঙ্গে অনুরোধটা করেছে, সেটাও মনে করছেন না কর্মকর্তারা। তারপরও এই বার্তার জবাব নিশ্চয় দেওয়া হবে। কিন্তু তার জন্য দিল্লি কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো করবে না বলেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।”

এর আগে ভারতের ইকনোমিক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, “সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হস্তান্তর করার জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও ভূ-রাজনৈতিক কারণ বিবেচনা করে ভারতের পক্ষ থেকে তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র হাসিনাকে ‘ফেরত’ পাঠানোর সম্ভাবনা কম।”

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রফিকুল ইসলাম গত ২৪ ডিসেম্বর ঢাকায় সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ভারতকে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সেটির উত্তর এলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে বাংলাদেশ। স্বাভাবিক সময়ে জবাব না এলে তাগাদাপত্র দেবে বাংলাদেশ।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গত বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, শেখ হাসিনাকে ফেরানোর চেষ্টার পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো চলবে। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, দুটি বিষয় পাশাপাশি চলবে। কারণ এটা হলো একটা ইস্যু। কিন্তু আমাদের আরো অনেক স্বার্থের ইস্যু আছে, দুপক্ষেরই। আমরা সেগুলো নিয়েও পাশাপাশি আগাব।’

 

হিন্দুস্তান টাইমসে প্রতিবেদন

ভারতের হিন্দুস্তান টাইমসে গতকাল শুক্রবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনাকে ফেরত চেয়ে বাংলাদেশ যে বার্তা পাঠিয়েছে তা বিধিসম্মতভাবে হয়নি। এ ছাড়া  বাংলাদেশ-ভারত বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের অনুরোধে সাড়া না দেওয়ার অনেক কারণ আছে। তবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গতকালের ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

 

চিন্ময় দাস প্রসঙ্গ

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্রিফিংয়ে সনাতন ধর্মীয় নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিনের আবেদন খারিজ হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হয়। জবাবে মুখপাত্র রণধীর জয়সোয়াল বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছি, ওই ঘটনায় যাঁদের ধরা হয়েছে তাঁরা সুবিচার পাবেন। বিচার ন্যায্য হবে।’

 

তুরস্ক থেকে সামরিক ট্যাংক কেনা প্রসঙ্গ

তুরস্ক থেকে বাংলাদেশের সামরিক ট্যাংক কেনার খবরের বরাত দিয়ে ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল, বাংলাদেশের ওই সিদ্ধান্ত ভারতের প্রতি কোনো বার্তা কি না। জবাবে রণধীর জয়সোয়াল বলেন, নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়ে ভারত সব সময় তীক্ষ নজর রাখে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে থাকে।

 

ভারতে বাংলাদেশি ধরপাকড় ও ফেরত

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশিদের ধরপাকড় ও ফেরত পাঠানোর বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে জয়সোয়াল বলেন, অবৈধভাবে দেশে ঢোকা মানুষদের খুঁজে বের করা ও ফেরত পাঠানো নিরাপত্তারক্ষীদের কাজ। তারা সেই কাজ করছে।

দুই দেশে আটকে থাকা জেলেদের হস্তান্তর প্রসঙ্গে জয়সোয়াল বলেন, ৯৫ জন ভারতীয় ও ৯০ জন বাংলাদেশি জেলে আগামীকাল রবিবার দুই দেশ থেকে মুক্তি পাবেন।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও এ ধরনের বার্তা দেওয়া হয়েছিল।

 

গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, বাংলাদেশকে সমর্থন

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র গত মাসে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রির ঢাকা সফরের সময় দেওয়া বিবৃতির কথা নতুন করে মনে করিয়ে দেন। সেই বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ভারত এক গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল ও সব শ্রেণির মানুষকে নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ দেখতে ও সমর্থন করতে চায়।

জয়সোয়াল বলেন, পারস্পরিক বিশ্বাস ও সম্মানের ওপর ভিত্তিশীল এবং যা পারস্পরিক সংবেদনশীলতা, উদ্বেগ ও স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়—বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার আগ্রহের কথাও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বাংলাদেশকে জানিয়েছেন।

সেই বিবৃতির বরাত দিয়ে মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের মূল লক্ষ্য দুই দেশের জনগণের কল্যাণ।

জিবি নিউজ24ডেস্ক//

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন