যেকোনো কাজের জন্য নীতিবহির্ভূতভাবে অর্থ লেনদেন করা কিংবা সুপারিশ থাকা মানেই সেখানে অন্যায় সংঘটিত হচ্ছে
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট ।
নির্ধারিত বেতন বা পারিশ্রমিকের বাইরে কর্মক্ষেত্র থেকে যা আয় করেন, যেখানে অন্যের হক জড়িত থাকে তা হারাম। আপনার কাছে ভিন্ন মাছায়লা থাকতে পারে কিন্তু যে সেবা বা খেদমত প্রদান করছেন তার বিনিময়ে যদি কাউকে জিম্মি করে অর্থ লেনদেন করেন তবে তা বিষ। কোন কাজের জন্য সরকার, সংস্থা বা ব্যক্তি আপনাকে পারিশ্রমিক দেওয়ার পরেও সেই কাজ করার বিনিময়ে আপনি অন্য কোন উৎস থেকে, কোন বাহান করে অর্থ হাতালে সেটাকে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নাই। ঘুষ বলেন কিংবা স্পিড মানি- রাষ্ট্র এর বৈধতা দিতে পারে কিন্তু সুশৃঙ্খল ধর্ম এটাকে জায়েজ বলেনি । হারাম চিরস্থায়ীভাবে, সর্বকালে হারাম। বৈধ অর্থের সাথেও যদি অবৈধ অর্থ মিশ্রিত হয় তবে সম্পূর্ণটাই হারামে পরিনত হয়। হারাম টাকায় কেনা খাদ্য শরীর জন্য বিষ। হারাম অর্থে সংগৃহীত শাস্তি জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে। কথায় বলে, হারামে আরাম নাই।
রাষ্ট্রের সাথে চাকুরিজীবীদের, মালিকের সাথে শ্রমিকের চুক্তি থাকে। কাজের সময় ও বিনিময় থাকে নির্ধারিত। কেউ যদি চুক্তিবদ্ধ সময়ে কাজে-দায়িত্বে ফাঁকি দেয় তবে সেটাও অবৈধ-অন্যায়। আবার কাজের জন্য নির্ধারিত বেতন গ্রহনের পরেও বাড়তি কোন সুযোগ-সুবিধা সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে আদায় করা কিংবা সেবা সহজীকরণের বদলে জটিল করে রাখাও নীতিবিরোধী। যা কিছু হারাম সেসবের বর্ণনা স্পষ্ট। কারো হক নষ্ট করছেন- হারাম। কারো আমানত খেয়ানত করছেন- হারাম। অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন না কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক মনোনীত হয়ে গোপনীয়তা ভঙ্গ করছেন- হারাম। কারো ওপর জুলুম করছেন- হারাম। কেবল সরাসরি ঘুষ খাওয়াই হারাম নয় বরং যেকোন দুর্নীতি- সেটা স্বজনপ্রীতি হোক, আর্থিক লেনদেন হোক কিংবা দায়িত্বপালনে অবহেলা হোক- অবশ্যই অন্যায়। দুনিয়াতে ভুলের শাস্তি হয় কিন্তু পাপের শাস্তি পরকালে। সৎ কর্ম কিংবা অসৎ কর্ম- কোনকিছুই বিনিময়হীন, ফয়সালাবিহীন যাবে না।
আপনি সেবা প্রদানের মালিক কিন্তু মানুষ আপনার কাছে গেলে দেখা পায় না, অপমান করেন কিংবা অন্যায্য কঠোরতা দেখান- কৈফিয়ত দিতে হবে। আপনি সরাসরি অবৈধ অর্থের লেনদেন করেন না কিন্তু আপনার সরলতা কিংবা উদাসীনতায় আপনার অধীনরা অফিসে অন্যায় সংঘটনের সাহস ও সুযোগ পায়- এর দায়ও আপনার। আপনার ওপর অর্পিত কোন বৈধ দায়িত্ব অবহেলা করা অপরাধ। ঘুষের পরিমান যাই হোক- প্রত্যেক পাপের জন্য খেসারত দিতে হবে। কোন অফিস কিংবা দপ্তরে ঘুষের লেনদেন হলে সেটার রেশ মাঠ পর্যায় পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। জনতার মধ্যেও অন্যায়ের বীজ বৃক্ষে পরিণত করে। সেজন্য ঘুষ দাতা এবং ঘুষ গ্রহীতা- উভয়কে ইসলামে দায়ী করা হয়েছে। তাদের জন্য জাহান্নাম অবধারিত করা হয়েছে। মানুষের মস্তিষ্কে যখন অন্যায় ঠাঁই পায় তখন সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে, চারদিকে অন্যায় ছড়িয়ে পড়ে এবং জনপদের ওপর ঐশ্বরিক বালা-মুসিবত ধেয়ে আসে। মানুষের পাপের কারণেও সমাজ-রাষ্ট্রকে ধ্বংসের দুর্বিপাকে পতিত হতে হয়।
যেকোনো কাজের জন্য নীতিবহির্ভূতভাবে অর্থ লেনদেন করা কিংবা সুপারিশ থাকা মানেই সেখানে অন্যায় সংঘটিত হচ্ছে। এতে কারো না কারো হক নষ্ট হচ্ছে এবং কেউ না কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ঘুষ-দুর্নীতিতে সরাসরি কোন ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। কর্মজীবনে অবৈধ পথে অর্থ কামাই করে কেউ সম্পদের কুমির হলে সেটা গোটা সার্ভিসভূক্তদের মধ্যে ক্ষতিকারক আছড় ফেলে। সামাজিক বৈষম্য ত্বরান্বিত করে। সকল সমাজে ব্যাধি সংক্রামক। যারা ঘুষ-দুর্নীতিতে জড়িত তারা কোনদিন তাদের সন্তানদের মানুষ করতে পারবে না। কেননা অমানুষদের সন্তান খুব অল্প সংখ্যকই মানুষ হয়। আপনি যদি শিক্ষিত হওয়া, সম্পদশালী হওয়া কিংবা ক্ষমতাবান হওয়ার সাথে মানুষ হওয়ার তফাৎ করতে না পারেন তবে আপনার সাথে বিতর্ক নাই। ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজদের সংসারে শান্তি আসবে না। কেননা কারো দীর্ঘশ্বাসের পয়সায় যাদের খাদ্য সংগ্রহ হয় সে খাবার বিষ হিসেবেই শরীরে প্রবেশ করে এবং রক্তে প্রবাহিত হয়। ফেরেশতারা তাদের ধ্বংস কামনা করে খোদার কাছে নালিশ জানাতে থাকে। খোদাও তাদের জীবন থেকে সুখ এবং বারাকাহময় নেয়ামত তুলে নেন।
সমাজ থেকে যেকোন উপায়ে ঘুষ-দুর্নীতি দূর করতেই হবে। দুর্নীতিবাজ যদি নিকটস্থ স্বজনও হয় তবে তার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করতে হবে। ঘুষখোর-অন্যায়কারী যদি কোন অফিসের বস হয়, সহকর্মী হয় কিংবা সমাজের কেউ হয় তবে তাকে বয়কট করতেই হবে। অন্তত আচরণে বোঝাতে হবে- দুর্নীতিবাজ-ঘুষখোরকে এই সমাজের মানুষ ঘৃণা করে এবং এড়িয়ে চলে। যারা অন্যায় করে তারা নিজের, পরিবারের, সমাজ ও রাষ্ট্রের সীমাহীন ক্ষতি করে। ক্ষতের এই দাগ তারা দেখে না। তারা সম্পদ হাসিলের নেশায় ন্যায়-অন্যায় সম্মন্ধে অন্ধ হয়। আইনের দ্বারা এই দুরাচারী ভন্ডদেরকে রুখে দিতে হবে। অন্তত এদের বিরুদ্ধে ঘৃণার অস্ত্র কখনোই যাতে নিস্ক্রিয় না হয়। ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজ আমাদের জাতীয় শত্রু। এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইন কঠোর করতে হবে, সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ঘুষ দেবো না, ঘুষ নেবো না- এই হোক নতুন বছরের শপথ ও প্রত্যয়।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন