যে দেশের সরকার আদেশ করেছে, সীমান্তে সীমান্তরক্ষীবাহিনী আর পিঠ নয় বরং বুক দেখাবে!
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
চোখে চোখ রেখে ন্যায্য কথা বলতে পারা এবং অধিকার আদায় করার যে মনোবল সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরীদের চোখে দেখছি তা অন্য এক অনন্য বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখায়। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের এক ইঞ্চি ভূমিও কেউ অন্যায়ভাবে দখল করতে পারবে না কিংবা বেদখল থাকবে না- সেজন্য সীমান্তের সব মানুষ দেশকে পাহারায় সজাগ থাকায় আমাদেরকে নতুন ভোরের স্বপ্ন বুনতে প্রেরণা দিচ্ছে। রাজনৈতি মতপার্থক্যের উর্ধ্বে উঠে এবং সকল বিভেদ ভুলে গিয়ে দেশের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নে সবার একাট্টা হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত আমাদের নির্ভয়তা শিখাচ্ছে। এককালের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশ ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান চাইছে। সাহসের সাথে চোখে চোখ বলছে অধিকারের কথা। ফিরে পেতে চাইছে লুণ্ঠিত স্বাধীনতা। নির্ভয় শ্যেনদৃষ্টিতে সীমান্তে বিডিয়ার জওয়ানরা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং তাদের পেছনে প্রেরণা দিচ্ছে সমগ্র বাংলাদেশের জনগণ- নারী, পুরুষ এবং শিশুরাও। দেশপ্রেমের এমন অজেয় নজির গতবছরের শীতেও সীমান্তে দেখা যায়নি। দেশপ্রেমিক নাবিকের বুকে এ যেন এক নতুন উষ্ণায়ণ। চোখে চোখে নয় বরং চোখে চোখ রেখে ন্যায্য দাবি আদায়ের যে শক্তি দেশপ্রেমিক ছাত্র-জনতার বুকে তা শত্রুপক্ষকে পিছু হটিয়ে দখলদারিত্বের শৃঙ্খল ভাঙতে টনিকের ভূমিকা নেবে। কন্ঠস্বর দরাজ করে গাইতে ইচ্ছা করছে, ' একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময় তুমি আমার অহংকার।'
ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী তথা বিএসএফ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের সাথে কখনোই বন্ধুসুলভ আচরণ করেনি। বিএসএফের গুলিতে ফেলানী হত্যার দগদগে ক্ষত আমাদের বুক থেকে এখনো শুকায়নি। মস্তিষ্ক থেকে শোকের মাতম এখন হারায়নি। ভারতের সাথে বাংলাদেশ ভিন্ন অন্যান্য যে সকল দেশের সীমান্ত সংযোগ আছে সে সকল দেশের বিরুদ্ধে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হত্যার সংখ্যা শুন্যের কাছাকাছি। এমনকি কোথাও কোথাও ফাঁকা আওয়াজ করতেও ভয় পায়! অথচ গত ১৫ বছরে বিএসএফের গুলিতে ভারত বাংলাদেশের ছয় শতাধিক মানুষকে সীমান্তে হত্যা করেছে। বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক ছিল খুবই মধুর! প্রায় স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মত! বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী তিপ্পান্ন বছরে এমন বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অন্য সময়ের কখনোই ছিল না। দহরমমহরমের এমন নজির অতীতে কেউ কখনোই দেখেনি। তবুও সীমান্তে বাংলাদেশের মানুষকে পাখির মত গুলি করে মেরে সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কের সাথে রঙ্গরসিকতা উদযাপন ও উপভোগ করা হয়েছে! দু'দেশের তরফেই মুখস্ত বয়ান হিসেবে নিহতদেরকে চোরাকারবারি, গরু পাচারকারী কিংবা নেশাজাত দ্রব্য বহনকারী হিসেবে তকমা দেওয়া হয়েছে! গুলিতে প্রাণ হারানো নিরীহ মানুষ, কৃষক কিংবা শ্রমিককে মিথ্যা অপবাদের দায় মাথায় নিয়ে কবরে শুইতে হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশের তরফ থেকে ভারতীয় সীমান্তবাহিনী কর্তৃক হত্যাকান্ডকে জায়েজ করার জন্য সফল প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়েছে! বানানো বয়ান পাঠানো হয়েছে পত্রিকায়। বন্ধুত্বের খোলসে যাতে দাগ না লাগে সেজন্য উপহার দেওয়া হয়েছে মাসুম মানুষের জীবন!
ভারত তাদের স্বার্থে বাংলাদেশের সাথে প্রভূ-ভৃত্যের সম্পর্কের রঙ্গলীলায় মেতে উঠেছিল। অতীতে তারা যা চেয়েছে তা উচ্চারণ করতে দেরী হয়েছে কিন্তু বুঝে পেতে দেরী হয়নি। তারা সমুদ্র বন্দর ব্যবহারে অনুমতি চেয়ে পেয়েছে, স্থলপথ ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছে, রেল ট্রানজিট পেয়েছে। আকাশসীমা ব্যবাহারের অনুমতি চেয়েও তাদেরকে নিরাশ হতে হয়নি। বুয়েটের আবরার ফাহাদের জীবন কেবল ভারতের আধিপত্যকামীতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কারণেই নৃশংসভাবে উৎসর্গ করতে হয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশ এমন অনেক চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে যেখানে বাংলাদেশের কোন লাভ তো হয়ইনি বরং সার্বভৌমত্ব ঝুঁকিপূর্ণ হয়েছে। কোন কোন সরকার ভারতের মদদে ক্ষমতার মসনদে টিকে থাকার জন্য বাংলাদেশকে অলিখিতভাবে সিকিমের পরিনতিতে ঠেলে দিচ্ছিল। কেবল ক্ষমতার জন্য লেন্দুপ দর্জির ভূমিকা বরণ করতে তাদের বিবেকে দেশপ্রেম দেয়াল হয়ে দাঁড়ায়নি। অথচ জনতাকে বোকা বানাতে তাদের বক্তৃতার দেশপ্রেমে অভিনেতার ডায়লগ ছিল। বাস্তবতা ছিল চরমভাবে ভিন্নতর। নয়তো তিস্তার পানি বাংলাদেশের কাছে অধরা থাকার কথা নয়। পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশের ফসল নষ্ট করা, জনপদ তলিয়ে দেওয়া কিংবা মানুষ ও পশুপাখির জীবন বিপন্ন করা- এসব ক্ষতিপূরণ ছাড়া যেতে পারে না। ভারত কর্তৃক পরিচালিত এসব অনাচারের বিরুদ্ধে মতামত দেওয়ার স্বাধীনতাও স্বাধীন বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রেখেছিল।
দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা প্রশ্নে জীবনবাজি ধরে সংগ্রাম করতে হবে। দশকের পর দশক বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তারা যে আগ্রাসী মনোভাব চালিয়েছে সেটা যে অন্যায়- তা ভারতকে বোঝাতে হবে। সব বদলানো যায় কিন্তু প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না। চব্বিশের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার যে গণ-অভ্যুত্থানের সফল প্রয়োগ হয়েছে তা মানুষের মধ্যে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন জুগিয়েছে। ভারতীয় সাধারণ নাগরিকদের সাথে বাংলাদেশের সাধারণ জনতার বিন্দুমাত্র শত্রুতা নাই। আমাদের মধ্যে ভারত বিরোধিতা নাই বরং ভারতের বর্তমান উগ্রপন্থী সরকারের বাংলাদেশ বিষয়ক নীতির বিরুদ্ধে আমাদের দৃঢ় অবস্থান। বৃহত্তর প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক আমাদের আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রস্থল কিন্তু সেই সম্পর্ক নির্মিত হতে হবে সমতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে। সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশের অধিকারের ইস্যূগুলো ন্যায্যতার ভিত্তিতে সুরাহা করতে হবে। ভারত বাংলাদেশের নৌ, স্থল ও আকাশসীমা ব্যবহার করতে পারবে তবে সেটা বিশ্বস্ততার সাথে; কোন ধরণের মেনস রিয়া নিয়ে নয়। ভারতে উৎপাদিত বিভিন্ন পন্যের বৃহৎ লাভজনক বাজার সমগ্র বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষকে কোন ধরণের হয়রানির উদ্দেশ্যে কিংবা ভোগান্তিতে ফেলতে আগাম ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ পন্য রফতানি বন্ধ করা যাবে না। এ বিষয়ক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি থাকা জরুরি। তিস্তাসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক কিংবা দু'দেশীয় মালিকানাধীন নদীর পানিতে বাংলাদেশের প্রাপ্য হিস্যা বুঝিয়ে দিতে হবে। কোনক্রমেই কোন বাঁধ খুলে দিয়ে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে কৃত্রিম বন্যা সৃষ্টি করে মানুষকে ভোগান্তির মধ্যে ফেলা যাবে না।
২০২৪ সালের ৫ আগষ্টের পূর্ব পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশ থেকে যা দাবি করেছে, কোন প্রকারের বাঁধা কিংবা প্রশ্নহীনভাবে তাই পেয়েছে। কিন্তু এখন তো ভিন্ন বাংলাদেশে। যে দেশের সরকার আদেশ করেছে, সীমান্তে সীমান্তরক্ষীবাহিনী আর পিঠ নয় বরং বুক দেখাবে! বাংলাদেশ জুড়ে ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে স্লোগান ও ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক বাংলাদেশের চেয়ে ভারতকে কম বেকায়দায় ফেলেনি কিংবা ফেলবে না। ভারতীয় ট্যুরিজমে এবং চিকিৎসাখাতে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশী ভারত ভ্রমন করতো। হোটেল-মোটেল, যানবাহন কিংবা বিপণীবিতানসহ নানা খাতে বাংলাদেশী সফরকারীদের উপস্থিতি ভারতীয় ব্যবসায়ী কিংবা জীবিকা অন্বেষণকারীদের জন্য প্রাণ-প্রবাহতুল্য রসদ জোগাত। সম্পর্কের অবনতিতে বাংলাদেশের লাগোয়া ভারতের কয়েকটি রাজ্যে হাহাকার তৈরি হয়েছে। ভারতীয় কতিপয় গুজব প্রচারকারী গণমাধ্যমে ইতরামিতে ভারতীয় কৃষকেরা ভারত সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও প্রতিবাদী হয়েছে। কেননা পিঁয়াজ-আলু কিংবা কাঁচামরিচের মত পচনশীল দ্রব্যের বাজার হিসেবে বাংলাদেশের মত লাভজনক বাজার দ্বিতীয়টি ভারতের নাগালে নাই। ভারত বাংলাদেশে গরু দেবে না এমন ঘোষণার পরেই বাংলাদেশের খামারিরা গবাদিপশু পালনে বিল্পব ঘটিয়েছে- নিশ্চয়ই মনে আছে! ভারত যদি বাংলাদেশের সাথে শত্রুতার ঘনত্ব বৃদ্ধি করে তাতে বাংলাদেশের চেয়ে কম ক্ষতি তাদের কপালে ঘটবে না! ভারতের তুলনায় আকার-আকৃতি, অর্থনৈতিক গুরুত্বে বাংলাদেশ একটি ক্ষুদ্র প্রতিবেশী রাষ্ট্র হতে পারে কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ ভারতের অখন্ডতা রক্ষার তাবিজ! অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের শত্রুতা মানেই বাংলাদেশের সাথে চীন-পাকিস্তানের বন্ধুত্বের বন্ধন শক্তিশালী হওয়া। তখন নিশ্চয়ই স্বস্তি ও নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশও বিশ্বস্ত বন্ধুত্ব তালাশ করবে! স্বভাবে ভারতের চেয়ে খারাপ প্রতিবেশী সামলেও বিশ্বের বহুদেশ সম্মানের সাথে টিকে আছে!
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন