গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতির চুক্তির খবর জানাজানি হওয়ার পর সেখানে ব্যাপক আনন্দ উদযাপিত হলেও বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের বাসিন্দারা ইসরায়েলের নতুন বিমান হামলার পর ধোঁয়া, ধ্বংসস্তূপ ও আরো মৃত্যুর মধ্যে দিন শুরু করে।
গাজার বাসিন্দা সাঈদ আল্লৌশ বলেন, ‘আমরা যুদ্ধবিরতির অপেক্ষায় ছিলাম এবং খুশি হয়েছি। এটা ছিল ৭ অক্টোবরের পর সবচেয়ে খুশির রাত।’
নিজের চাচার মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘হঠাৎ করে...আমরা ৪০ জন নিহত হওয়ার খবর পেলাম।
এলাকার পুরো আনন্দ দুঃখে পরিণত হলো, যেন কোনো ভূমিকম্প হয়েছে।’
এই বিমান হামলাগুলো হয় কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণা করা এক ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর, যা রবিবার থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। এএফপির হামলার বিষয়ে মন্তব্য জানতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।
অন্যদিকে গাজার বেসামরিক সুরক্ষা সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল এএফপিকে জানান, যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর থেকে অন্তত ৭৩ জন ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছে।
নিহতদের মধ্যে ২০ শিশু এবং ২৫ নারী রয়েছে। এ ছাড়া প্রায় ২০০ জন আহত হয়েছে।
ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ধ্বংস হওয়া ভবনের অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা ও ধ্বংসাবশেষ পরিষ্কার করতে ভিড় জমে যায়, যেখানে কংক্রিটের টুকরা ও রডের মধ্যে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। এই দৃশ্য গাজার অন্য অংশগুলোতেও দেখা গেছে, যেখানে ২৪ লাখ মানুষের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার বেশির ভাগ মানুষই যুদ্ধের কারণে অন্তত একবার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
খান ইউনিস শহরের প্রধান চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নাসের হাসপাতালে এএফপির সাংবাদিকরা দেখেন, নিহতদের রক্তে মর্গের স্ট্রেচারগুলো ভিজে গেছে। অন্যদিকে গাজা সিটির আল-আহলি হাসপাতালে শোকসন্তপ্ত পরিবারগুলো তাদের প্রিয়জনদের মৃতদেহের সামনে শোক প্রকাশ করছিল। সেখানে হামলার শিকার বেশ কিছু হতাহতকে আনা হয়েছিল।
উদ্ধারকর্মী ইব্রাহিম আবু আল-রিশ এএফপিকে বলেন, ‘যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর যখন সবাই খুশি ছিল, তখন একটি পাঁচতলা ভবন লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়, সেখানে ৫০ জনেরও বেশি লোক ছিল।’
মাঠায় লাইট লাগিয়ে উদ্ধারকর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দারা গাজা শহরের ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তায় মধ্যরাতে ধ্বংসস্তূপের মাঝে অনুসন্ধান চালাচ্ছিল।
গাজার বেসামরিক সুরক্ষা সংস্থার অ্যাম্বুল্যান্সচালক আবু আল-রিশ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘গোলাবর্ষণ এখনো চলছে, একের পর এক বাড়ি লক্ষ্য করে হামলা চলছে।’
‘অত্যন্ত রক্তাক্ত রাত’
মধ্য গাজার আল-বুরেইজ শরণার্থী শিবিরের বাসিন্দা মাহমুদ আল-কর্ণাওয়ি বলেন, ‘যত দিন চুক্তি কার্যকর না হবে, তত দিন গাজার মানুষ অরক্ষিত থাকবে। গুলি থেমে নেই, বিমানগুলো আকাশে এখনো আছে এবং পরিস্থিতি খুবই কঠিন।’
এই কারণে কর্ণাওয়ি ও নুসেইরাত শহরের কয়েকজন বাসিন্দা এএফপির সঙ্গে কথা বলার সময় জানান, তারা পরবর্তী ঘটনাবলি নিয়ে উদ্বিগ্ন। গাজার বাস্তুচ্যুত বাসিন্দা মোতাজ বেকির নুসেইরাত বাজার থেকে বলেন, ‘আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। আগামী তিন দিনে আমরা এমন এক রক্তপাতের আশঙ্কা করছি, যা আগে থেকে আরো ভয়াবহ হতে পারে।’
এদিকে আন্তর্জাতিক দাতব্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ডক্টরস উইথআউট বর্ডারস (এমএসএফ) বলেছে, গাজায় কেউ এখনো নিরাপদ অনুভব করতে পারছে না। সংস্থাটির জরুরি সমন্বয়কারী আম্যান্ডে বাজেরল ফোনে এএফপিকে বলেন, ‘গত রাতে ২০ মিনিটের জন্য অনেক উল্লাসধ্বনি ছিল, তারপর এটা হয়ে ওঠে এক অত্যন্ত রক্তাক্ত রাত।’ তার কথার মাঝেও গোলাবর্ষণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা বৃহস্পতিবার গাজা চুক্তি অনুমোদনের কথা বলেছে। তবে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর হামাসের বিরুদ্ধে চুক্তির কিছু শর্ত থেকে সরে আসার অভিযোগ তুলেছে। প্রধান মধ্যস্থতাকারী কাতার ও যুক্তরাষ্ট্র বুধবার বলেছিল, ইসরায়েল ও হামাস রবিবার থেকে গাজায় যুদ্ধবিরতি এবং বন্দি ও জিম্মি বিনিময়ের জন্য এক চুক্তিতে সম্মত হয়েছে। যদি এই ভঙ্গুর চুক্তি অনুমোদিত হয়, তাহলে প্রথম ধাপে ৩৩ জন জিম্মি মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে বলে কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জসিম আল-থানি জানিয়েছেন।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের নজিরবিহীন এক হামলার পর গাজা উপত্যকাজুড়ে এ যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ইসরায়েলের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সেই হামলায় এক হাজার ২১০ জন নিহত হয়, যাদের বেশির ভাগই বেসামরিক। অন্যদিকে ইসরায়েলের পাল্টা সামরিক অভিযানে গাজায় এখন পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৭৮৮ জন নিহত হয়েছে, যার বেশির ভাগই বেসামরিক। হামাসশাসিত অঞ্চলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এ পরিসংখ্যানকে জাতিসংঘ বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করে।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন