হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।
সিলেটের কিংবদন্তী আলেম, লাখো আলেমের উস্তায, আরব আমিরাতের সাবেক বিচারপতি, শাইখুল হাদীস, উস্তাযুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন হযরত আল্লামা হবিুবর রহমান মুহাদ্দিস ছাহেব যেমন ছিলেন ইলমে শরীয়তের প্রখ্যাত আলিম, তেমনি ছিলেন ইলমে মারিফতেরও শায়খে কামিল। তিনি ছিলেন শামসুল উলামা আল্লামা ফুলতলী ছাহেব ক্বিবলাহ রহ. এর অন্যতম খলীফা এবং বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল ইসলাহ-এর সাবেক সভাপতি। বর্ণাঢ্য তাঁর জীবন-ইতিহাস। অত্যন্ত মেধাবী এই মনীষী ছাত্র হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, মুহাদ্দিস হিসেবে, প্রিন্সিপাল হিসেবে, মুবাল্লিগ-ওয়ায়েজ হিসেবে, বিভিন্ন দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে, কোর্টের বিচারক হিসেবে প্রখর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দেশে এবং বিদেশে রয়েছে তাঁর অগনিত গুণগ্রাহী, ভক্ত, অনুগামী ও অনুসারী।
জন্ম:
সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার রারাই গ্রামে ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন সর্বসাধারণের কাছে ‘মুহাদ্দিস ছাহেব’ নামে খ্যাত শাইখুল হাদীস হযরত আল্লামা হবিবুর রহমান মুহাদ্দিস ছাহেব (রহ.)। তাঁর পিতা এলাকার খ্যাতিমান আলিমে দীন মরহুম মাওলানা মুমতায আলী রহমতুল্লাহি আলাইহি। মাতা মরহুমা আমিনা খাতুন। সাত ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়।
মৃত্যু:
ইলমে হাদীসের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, বহু উস্তাদের উস্তাদ শায়খুল হাদীস আল্লামা হবিবুর রহমান মুহাদ্দিস ছাহেব চিরদিনের মতো এই জগৎ থেকে চলে গেলেন। মুহাদ্দিস ছাহেব বলে খ্যাত এই বুর্যুগ্ গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ সোমবার সন্ধ্যা ৬.৩০ মিনিটে সিলেটের জকিগঞ্জস্থ নিজ বাসভবনে ইন্তেকাল করেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ৮ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বিশাল জানাজার জামাত শেষে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদের পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।
শিক্ষা জীবন:
এলাকার প্রাইমারি স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করে বাল্য বয়সেই তিনি বড়ভাই মরহুম মাওলানা নজিবুর রাহমান রাহিমাহল্লাহ’র সাথে বর্তমান ভারতের বদরপুর সিনিয়র মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে কিছুদিন লেখাপড়া করে ফিরে এসে কানাইঘাট থানাধীন সড়কের বাজার আহমদিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। এখানে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। সড়কের বাজার মাদরাসায় ছাত্র থাকাকালীন শিক্ষকগণের উৎসাহে পার্শ্ববর্তী প্রাইমারি স্কুল থেকে জেলা-ভিত্তিক প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মেধাতালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে বৃত্তিপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে সিলেটের অন্যতম প্রাচীন ইসলামি বিদ্যাপীঠ গাছবাড়ি জামেউল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তান মাদরাসা এডুকেশন বোর্ডের অধীনে আলিম পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান লাভ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। একই মাদরাসা থেকে ১৯৫৭ সালে ফাজিল পরীক্ষায় বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় তৃতীয় স্থান লাভ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৯ সালে হাদীস বিভাগে কামিল পরীক্ষায় বোর্ডের সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বাদশ স্থান লাভ করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য যে, গাছবাড়ি মাদরাসার ইতিহাসে বোর্ডের মেধা তালিকায় স্থান লাভকারী প্রথম ছাত্র তিনি। তাঁর পীর ও মুরশিদ শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর কাছে হাদীস শিক্ষা অর্জনের পাশাপাশি কিরাতও অধ্যয়ন করেন এবং কিরাতের সনদ লাভ করেন।
কর্মজীবন:
১৯৫৯ সালের ৩রা আগস্ট ইছামতি দারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসায় সহকারী মাওলানা পদে যোগদান করেন। ১৯৬৩ সালের ১০ এপ্রিল সিলেটের প্রাচীনতম ইসলামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ফুলবাড়ি আজিরিয়া মাদরাসায় যোগ দেন। স্বীয় পীর ও মুরশিদ হযরত ফুলতলী ছাহেব কিবলা রহমাতুল্লাহি আলাইহির নির্দেশে ১৯৬৩ সালের ২৩ নভেম্বর সৎপুর দারুল হাদীস মাদরাসায় প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪ সালের চৌদ্দ জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানে সুনামের সাথে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৪ সালের ১৫ জানুয়ারি ইছামতি দারুল উলুম মাদরাসায় অধ্যক্ষ পদে যোগদান করেন। ইতোমধ্যে সৎপুর দারুল হাদীস মাদরাসার অধ্যক্ষ নিয়ে মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যা নিরসন কল্পে জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিগণের অনুরোধে ১৯৭৬ সালের এগারো অক্টোবর সেখানে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দেন। তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে অল্প দিনের মধ্যে মাদরাসার স্থিতিশীলতা ফিরে এলে ১৯৭৭ সালের দুই এপ্রিল সেখান থেকে চলে আসেন।
আরব আমিরাতে অবস্থান:
১৯৭৭ সালে তিনি চলে যান সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সেখানে প্রথমে উম্মুল কুওয়াইন নামক শহরের একটি জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব নিযুক্ত হন। সেখানে প্রতিযোগিতামূলক এক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন।
বিচার বিভাগে যোগদান:
বিচার বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত উম্মুল কুওয়াইন কোর্টে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দেশে প্রত্যাবর্তন:
দেশে প্রত্যাবর্তন করে এবং আবার তাঁর পুরাতন কর্মস্থল ইছামতি মাদরাসায় প্রিন্সিপালের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে অত্যন্ত সুনাম-সুখ্যাতি ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ঐ তারিখেই তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে অবসর গ্রহণ করেন এ দায়িত্ব থেকে।
মাদরাসার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর:
মাদরাসার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলেও ইলমে হাদীসের খিদমত থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হননি কখনও। হাদীসের প্রচার, দরস-তদরীস, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদান, ওয়াজ নসীহত, তরিকতের তালিম ও তলকীন জারি রেখেছেন আজীবন। এমন কি মৃত্যুসজ্জায় শায়িত অবস্থাতেও তিনি আগ্রহী প্রার্থীদের সবক দিয়েছেন, সনদ দিয়েছেন, নসীহত করেছেন। তাঁর জীবন ছিল দ্বীনের জন্য কুরবান। ইলমী তাজকিরা থেকে তিনি বিরত থাকেননি কখনও। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বসচেতন ও কর্তব্যনিষ্ঠ।
১৯৯১ সালে তাঁর সম্পাদনায় সিলেট থেকে ‘মাসিক শাহজালাল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বিভিন্ন দ্বীনী কিতাব প্রণয়ন করে গেছেন তিনি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে আল কাউলুল মাকবুল ফী মীলাদির রাসূল, দোয়ায়ে মাসনুনা ও তেত্রিশ আয়াতের ফযীলত, মাসআলায়ে উশর: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, দুরূদ শরীফের ফযীলত ও ওযীফা, যিয়ারতে মদীনা মুনাওয়ারা (ফযীলত ও নিয়ম), আসহাবে বদর, ওযীফা, হজ্জ ও যিয়ারত (সংক্ষিপ্ত আহকাম ও নিয়ম), হাদীয়াতুল লাবীব ফী নাবযাতিম মিন সীরাতিন নাবিয়্যিল হাবীব, যাখীরাতুল আহাদীসিল আরবাঈন ফী ফাদায়িলি সায়্যিদিল মুরসালিন, কানযুল আহাদীসিল আরবাঈন ফী মানাকিবি আহলি বাইতিন নাবিয়্যিল আমীন, তুহফাতুল লাবীব ফী আসানীদিল হাবীব, আত তুহফাতুল লাতীফাহ ফী আহাদীসিল মুসালসালাতিল মুনীফাহ, দালাইলুল খাইরাত (তাহকীক ও বিন্যাস) ও আল হিযবুল আযম (তাহকীক), সীরাতে হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইত্যাদি। প্রায় ষাট বছর ধরে ইলমে হাদীসের খিদমতে নিরলসভাবে নিয়োজিত ছিলেন এই মনীষী। তিনি হাদীস শরীফের যে দরস দিয়ে গেছেন তা এক অমূল্য সম্পদ।
রাব্বুল আলামিন যেন শায়খুল হাদীস আল্লামা মুহাদ্দিস ছাহেব হুজুরকে জান্নাতের সর্ব উচ্চ মর্যাদা দান করেন, আমীন।
লেখক: বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ লেখক ও কলামিস্ট হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী। সাবেক ইমাম ও খতিব কদমতলী হযরত দরিয়া শাহ্ (রহ.) মাজার জামে মসজিদ সিলেট।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন