সিভিল সার্ভিস সংস্কারের মাধ্যমে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনে ক্যাডারগুলোর মধ্যে বৈষম্য নিরসন ও প্রশাসন ক্যাডার নির্ভরতা কমানোর দাবি জানিয়েছে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য পরিষদ। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রশাসন ক্যাডারের একচেটিয়া আধিপত্যের সমালোচনা করে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের প্রাধান্য দেওয়ার প্রস্তাবও করেছে সংগঠনটি।
শনিবার ( ১৮ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ‘জন আকাঙ্ক্ষা পূরণে প্রত্যাশিত সিভিল সার্ভিস’ শীর্ষক সেমিনারে এই দাবি জানায় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য পরিষদ।
সিভিল সার্ভিসের ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ এই সেমিনারের আয়োজন করে। বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্তা, অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, অসরপ্রাপ্ত বিচারক, শিক্ষক, লেখক এবং রাজনীতিবিদ আলোচনায় অংশ নেন।
সেমিনারে বিদ্যমান সিভিল সার্ভিস ব্যবস্থায় রাষ্ট্র ও জনগণের ক্ষতিসমূহ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, বৈষম্যের কারণে পেশাদারত্বকে প্রাধান্য না দেওয়ায় দৈনন্দিন কাজে দীর্ঘসূত্রতা ও জনমনে অসন্তুষ্টি, সিভিল সার্ভিসে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার মাধ্যমে রাজনীতিতে স্বৈরাচারিতা কায়েম, প্রশিক্ষণে অর্থ অপচয়, জনগণের অর্থ অপচয়, অদূরদর্শী প্রকল্প গ্রহণ, জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতার অভাবের সমস্যা তৈরি হয়েছে। এতে মেধার অবমূল্যায়ন ও জনসেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে মন্ত্রণালয়গুলোতে ভারসাম্যহীনতা, জবাবদিহিহীনতা একটি ক্যাডারের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার কারণে সিভিল সার্ভিসে বৈষম্য তৈরি হয়েছে।
এ সময় বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর নাসরিন বেগম বলেন, সিভিল সার্ভিসে বৈষম্য দূর করে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের সুযোগ এসেছে। প্রশাসন ক্যাডারের কর্তৃত্ব এতই বেশি যে তারা সরকারকেই জিম্মি করে ফেলে। শুধু প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া বাকি যে ২৫টি ক্যাডার রয়েছে তাদের সঙ্গে প্রতিটি সরকার বিমাতাসুলভ আচরণ করে। এই বৈষম্য নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম চলছে। এই দীর্ঘ সংগ্রামে এখনো আমরা সফল হতে পারিনি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক কৃষিবিদ আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবাল বলেন, বিগত ১৫ বছরে আমরা দেখেছি সবকিছু ফ্যাসিবাদি কায়দায় সবকিছু কবজা করা হয়েছে। ২৬ ক্যাডারের পরিবর্তে ৬টি গুচ্ছ ক্যাডার করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। যদি এটা হয় তাহলে ক্ষমতা এককেন্দ্রীকরণ হবে অথচ জনগণ ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ চায়। জুলাই বিপ্লবে এত মানুষ শহীদ হয়েছেন শুধু বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়ার জন্য নয়। বৈষম্যের মাধ্যমেই আন্তঃক্যাডার চরম পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ডিসি-ইউএনও’দের সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। তারা সব বিষয়ে খবরদারি করেন। এসব বৈষম্য দূর করতে হবে।
এসসিবিএ সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, সিভিল সার্ভিসের ক্যাডারদের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে হবে। কারণ দিন শেষে এর ফল ভোগ করবে দেশের জনগণ।
অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ ড. শাহজাহান সাজু বলেন, অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের দাবি দাওয়া নিয়ে সরব হলে তাদের শাস্তি হয়, কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দাবি জানালে তাদের বদলি বা শাস্তি হয় না। কিছুদিন আগে জেলা প্রশাসক নিয়োগ নিয়েও এমনটা হয়েছে। যে যেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদের সেসব জায়গায়ই দায়িত্বে থাকা উচিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহবুব বলেন, সরকার জনপ্রশাসন-পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করেছে তবে এটা সিভিল সার্ভিস সংস্কার কমিশন হলে ভালো হতো। স্টেকহেল্ডারা যদি রাজি থাকে, কর্মকর্তাদের পদোন্নতির ক্ষেত্র একটা স্বাধীন কমিশন করা যেতে পারে। যারা স্বাধীনভাবে কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিয়ে কাজ করবে। এই রাষ্ট্র আমাদের সবার, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের এই রাষ্ট্র বিনির্মাণ করতে হবে।
লেখক ও কলামিস্ট ফিরোজ আহমেদ বলেন, আমলাদের কারণে দেশের আর্থিক অপচয় হয়। তারা দুর্নীতি করে বিদেশে অর্থপাচার করে। তাদের দুর্নীতির সুযোগের জন্য অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। মন্ত্রণালয়ের প্রধান হওয়া উচিত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞদের। আমলাতন্ত্রকে জনগণের জবাবদিহির মুখে আনার সময় হয়েছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, আপনাদের দাবির যৌক্তিকতা আছে। বর্তমান যে সিস্টেম রয়েছে সেটি কলোনিয়াল সময়ের। এটাকে পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এই বিষয়ে সচেতনতা তুলে ধরতে হবে। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন তাদের নানান ধরনের নামে ডাকা হয়। যেমন প্রশাসক, অথবা সেবা দেওয়ার কথা থাকলেও এই নামে ডাকা হয়। আমরা দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনের জায়গা থেকে কাঠামোগত পরিবর্তন চাই। একজন ডিসি যিনি জনগণের সেবা করার জন্য এসেছেন, এটা তার মনে থাকা দরকার।
তিনি বলেন, আলাদা ক্যাডার তৈরি করা হয়েছে বিশেষায়িত জ্ঞানের জন্য। বাংলাদেশে এই আন্দোলনটা সামাজিক আন্দোলন হওয়া দরকার। আমরা প্রশাসনকে গণতন্ত্রীকরণ করার প্রস্তাব করেছি। এই লড়াই সবাই একসঙ্গেই করতে হবে। ক্যাডারদের বৈষম্য যেদিন থাকবে না সেদিন থেকে দেশের জনগণ প্রকৃত সেবা পাবে।
সেমিনারে কৃত্যপেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা, অন্য সব মন্ত্রণালয় বা বিভাগে দায়িত্ব পালনের জন্য উপসচিব ও তদূর্ধ্ব পদে কোটা পদ্ধতি বাতিল করে এসএসপি পুলের আদলে মেধাভিত্তিক সিভিল প্রশাসন প্রতিষ্ঠা এবং আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর করে জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র কাঠামোর মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত সেবার পরিবেশ তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন