পঁচিশ টাকা চুরি করে যে পাঁচ টাকা দান করে- এই সমাজ তাকে পুজো করতে করতে হুঁশ হারিয়ে ফেলে।
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
কেউ হাত বাড়িয়ে ঘুষ গ্রহণ করে। কেউ ঘুষ না দিতে চাইলে তার সাথে গোস্বা ধরে। কেউ নেশাজাত দ্রব্য ভক্ষণ করে কিংবা একজন অনিয়মে অভ্যাস গড়ে, আরেকজন বিশ্বাস ভাঙে- এদেরকে ভালো মানুষ কেন বলতে হবে? এক লোক মসজিদেও যায় আবার মিথ্যা কথাও কয়- তাকে জান্নাতে পাঠানোর ইজারাদাররা আদৌ জান্নাতে যেতে পারবে কি না- সে ফয়সালা কি নবী-রাসুলগণ দিয়ে গেছেন? অথচ মসজিদ-মন্দিরে দু'পয়সা খয়রাত পেলে, মাহফিল-মাদ্রাসায় মোটা অঙ্কের অনুদান পেলে কিংবা কোন অন্যায়ের সাপোর্ট পেলে- গাধার স্বরের মত উচ্চস্বরে মাইকে অমানুষকেও বেহেশত পর্যন্ত পৌঁছে দেই! খুনীকে পাঠাই জান্নাতুল ফেরদাউসে! মনে হয় যেন ধর্ম তাদের দাদার সম্পত্তি আর স্রষ্টা তাদের নানার পক্ষের আত্মীয়!
পঁচিশ টাকা চুরি করে যে পাঁচ টাকা দান করে- এই সমাজ তাকে পুজো করতে করতে হুঁশ হারিয়ে ফেলে। রাষ্ট্রের যত বড় বড় দানব তাদের মান সম্মান তত বেশি! যারা নীতির বাইরে গিয়েও ক্ষমতা দেখাতে পারে, যারা হুমকি দিয়ে স্বার্থ বাগিয়ে নিতে পারে- তাদের পায়ে গোটা সমাজ নতজানু! মনে হয় স্বর্গ তাদের কাছে! যারা যতবেশি অনিয়ম করে প্রতিষ্ঠান তাদেরকে ততবেশি যোগ্য বলে বিজ্ঞাপন করে! বোধবিজ্ঞান পচে গেলে লুটেরারা তরুণদের আইডল হয়! শরীর বিক্রিকারীরা হয় মডেল! ভুল মানুষকে আদর্শ মেনে এই সমাজের যে কী সাংঘাতিক ক্ষতি হচ্ছে সেসবের আছড় সমাজে শুরু হয়েছে! মানুষের মত মানুষ খুঁজে পেতে চালু করতে হবে মানুষ শুমারী!
সমাজ একজন সৎ মানুষকে দু'পয়সার মূল্যায়ন করে না। সৎকে অফিসে মফিজ মনে করা হয় আর বাজারে ট্রিট করা হয় ভিখারি হিসেবে! সমাজ যতখানি পচে গেলে সৎ মানুষদের সম্মানহারা হতে হয় ততখানি পচনের গভীরে এই সমাজ পৌঁছেছে। যেখানে মানুষের অবস্থানকে টাকা দিয়ে মাপা হয়, সম্মান দেওয়া হয় ক্ষমতার বিচারে এবং ভালো বলা হয় কুৎসিত মানসিকতাকে আড়ালে রেখে কৃত্রিম মুখোশ দেখে- সেই সমাজে ভালো মানুষের বিচরণ চার দেয়ালে বন্দী! কাকপক্ষীও জানে না দেয়ালের ওপারে দু'জন ভালো মানুষ কোনমতে বেঁচে আছে! অথচ যারা বেচে দিয়েছে বোধ, বন্ধ করে দিয়েছে বিবেকের দরজা- তারাই এখন সমাজের বিচার-ফয়সালা করে! অধিকাংশ ক্ষেত্রে চরিত্রহীনরাই অন্যকে প্রদান করে চারিত্রিক সনদপত্র!
এই সমাজে ভালো মানুষের তকমা পায় কারা? যারা নির্বাচনে শতকোটি টাকা বিনিয়োগ করতে পারে! জাহাজ ভর্তি করে দেশের টাকা বিদেশে পাচার করতে পারে কিংবা ভাড়া করতে পারে অভিজাত হোটেলের সুরাবাহী কামরা! একজন সৎ মানুষকে সমাজের আদর্শ মেনে তরুণদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে? একজন ভালো মানুষকেও দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনা? কিংবা কোনদিন বলা হয়েছে তোমরা অমুকের মত সাদা মনের হও! সন্তাদের আদর্শ করা হয়েছে নায়ক-গায়ক, সম্পদশালী বাটপার আর ঘুষখোর চাকুরিজীবীকে! দেশের পঁচিশজন দুর্নীতিবাজের নাম এক নিঃশ্বাসে বলা সম্ভব হলেও জাতীয় পর্যায়ের পাঁচজন ভালো মানুষের নাম বলতে ঘামতে হবে! সমাজ-রাষ্ট্র ভালো মানুষ উৎপাদনের সেই প্রজেক্ট আন্তরিকভাবে গ্রহন-ই করেনি!
সন্তানদেরকে শেখানো হয়েছে টাকাই সব, দেখানো হয়েছে ভোগেই সুখ! পরিবার-প্রতিষ্ঠানে চর্চা হয়েছে- মুখের কথা আর মনের কথায় বিস্তর ফারাক! এই সমাজে খারাপকে যত আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয় ভালো কাজ তত কদর পায় না! পত্রিকার লাল অক্ষরের খবর, টেলিভিশনের হট ব্রেকিং কিংবা সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের বিছানা-বালিশ যত রঙচঙে উপস্থাপন করা হয়, একজন মহৎ মানুষকে সমাজের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে, ভালো কাজের স্বীকৃতি দিতে সমাজের ততটা আগ্রহ নাই! অথচ ভালো মানুষের সাকো ছাড়া এই সমাজের সামনে অগ্রসর হওয়ার কোন সুযোগ নাই! আমরা যতট স্বার্থপর ততটা পরার্থপরতা দেখাতে পারলে সমাজ-সংসারে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতো।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন