নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যে শুধু ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে জালিয়াতির নির্বাচন উল্লেখ করে এর দায় নিরূপণের জন্য একটি বিশেষ তদন্ত কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছে।
গত ১৫ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে যে প্রতিবেদন দেওয়া হয় তাতে এই সুপারিশ জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনের ‘নির্বাচনী অপরাধ/কমিশনের অপরাধ’ অংশের পাঁচ দফা সুপারিশের (ঙ) দফায় বলা হয়, ‘২০১৮ সালের জালিয়াতির নির্বাচনের দায় নিরূপণের জন্য একটি বিশেষ তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।’
বিতর্কিত এই নির্বাচনের সময় কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে অন্য চার নির্বাচন কমিশনার ছিলেন মাহবুব তালুকদার, মো. রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম ও ব্রি. জে. (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী।
এই চারজন কমিশনারের মধ্যে মাহবুব তালুকদার নির্বাচনে অনিয়মের বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিলেন।
তিনটি বিতর্কিত নির্বাচনের মধ্যে একটি নির্বাচনের বিষয়ে বিশেষ তদন্ত কমিশন কেন চাইছেন—এ প্রশ্নে ড. বদিউল আলম মজুমদার গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠকে বলেন, “তিনটি নির্বাচনের মধ্যে দুটি নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ছিল না। একপক্ষীয় ওই দুটি নির্বাচন প্রকৃত অর্থে নির্বাচনই ছিল না। কিন্তু ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের মানুষ আশা করেছিল, একটি অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হবে।
এই নির্বাচনে নিজেদের জয় নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে ‘রাতের ভোট’-এর ব্যবস্থা করে। প্রতিপক্ষকে মাঠে দাঁড়াতে দেয়নি। এই নির্বাচনেই জোর-জুলুম-জালিয়াতি বেশি হয়েছে। কেন্দ্র দখলে নিয়ে প্রকাশ্যে ব্যালট বাক্স ভরা এবং অবিশ্বাস্যভাবে শতভাগ ভোট পড়ার গঠনা ঘটে।
এ কারণে আমরা এই জালিয়াতির নির্বাচন তদন্তে কমিশন গঠন করার সুপারিশ করেছি। তবে সরকার চাইলে দশম ও দ্বাদশ নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের দায় নিরূপণের জন্যও তদন্ত চালাতে পারে। কারণ ওই নির্বাচনেও সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কমিশনাররা তাঁদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। তাঁরা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারেননি। এতে তাঁদের শপথ রক্ষা হয়নি।
”
কেমন ছিল বিতর্কিত তিন নির্বাচন
বিতর্কিত ওই তিনটি নির্বাচনের মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো বর্জন করে। এ নির্বাচনে নজিরবিহীনভাবে ১৫৩টি আসনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটভুক্ত দলগুলোর প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুসারে এ নির্বাচনে মোট ৯ কোটি ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ১৬৭ ভোটারের মধ্যে ১৫৩ আসনের চার কোটি ৮০ লাখ ২১ হাজার ৯৮৩ ভোটারের ভোট দেওয়ার সুযোগই ছিল না। বাকি ১৪৭ আসনের চার কোটি ৩৯ লাখ ৪৩ হাজার ১৮৪ ভোটারের মধ্যে ৬০ শতাংশ ভোটার ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনও বিরোধী দলগুলো বর্জন করায় এই নির্বাচনে মূলত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় আওয়ামী লীগ ও একই দলের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে। একপক্ষীয় এ নির্বাচনও অনিয়মের অভিযোগমুক্ত ছিল না। আর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক হামলা-মামলাসহ নানা অনিয়ম ও ভোট জালিয়াতির ঘটনা ঘটে।
এই নির্বাচন সম্পর্কে ২০২০ সালে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বিশ্লেষণধর্মী এক প্রতিবেদনে বলা হয়—এটি ছিল একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। মহাজোটের বিপরীতে ড. কামাল হেসেনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে ২০ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলোও যুথবদ্ধভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে।
সব নিবন্ধিত দলের অংশ নেওয়ার কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শুধু অংশগ্রহণমূলকই ছিল না, এতে বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি প্রার্থী অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু এর পরও এটি প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ছিল না। এতে সব দলের সমসুযোগ না পাওয়ার অভিযোগ ওঠে। এর মূল কারণ ছিল, প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-হামলা ও দমন-পীড়ন, বিরোধী দলের প্রার্থীদের ওপর হামলা এবং তাঁদের নানাভাবে হয়রানি।
এ ছাড়া নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হওয়ার কারণে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলও হয় প্রায় একতরফা। নির্বাচনে ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট পায় ২৮৮টি আসন। অপরদিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পায় মাত্র আটটি আসন।
কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল থেকে দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ পেয়েছে মোট প্রদত্ত ভোটের ৭৪.৪৪ শতাংশ, অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) পেয়েছে মাত্র ১২.০৭ শতাংশ ভোট। ২১৩টি কেন্দ্রে শতভাগ এবং এক হাজার ৪১৮টি কেন্দ্রে ৯৬ শতাংশের ওপরে ভোট পড়ে, যা অস্বাভাবিক।
আরো দেখা গেছে, ৭৫টি আসনের ৫৮৭টি কেন্দ্রের সব বৈধ ভোট শুধু একজন করে প্রার্থী পেয়েছেন। অন্য কোনো প্রার্থী একটি ভোটও পাননি। এই ৫৮৭টি কেন্দ্রের মধ্যে ৫৮৬টিতে (৯৯.৮৩ %) সব ভোট পেয়েছেন নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা।
সুজনের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘এসব তথ্য আমলে নিলে সহজেই বলতে পারি যে আমরা এবার এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনই প্রত্যক্ষ করেছি। এর ফলে একাদশ নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট নিরসনের যে প্রত্যাশা আমরা করেছিলাম তা পূরণ হয়নি। নির্বাচন কমিশনের কার্যকর পদক্ষেপ ছাড়া এবং দলীয় সরকারের অধীনে যে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না, তা আরেকবার প্রমাণিত হলো।’
ওই নির্বাচনে ভোটের দিন বিবিসি বাংলার এক খবরে বলা হয়, ‘চট্টগ্রাম-১০ আসনের শহীদনগর সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রে গিয়ে সকালে ভোট গ্রহণের আগে ব্যালট বাক্স ভরা দেখেছেন বিবিসির সংবাদদাতা।’ দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোতেও এ ধরনের ঘটনার সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়।
২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যালোচনা’ শীর্ষক গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদনে জানায়, এই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন—সব দলের সভা-সমাবেশ করার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, বিরোধীদের দমনে সরকারের বিতর্কিত ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে অবস্থান নেওয়া, সব দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা সমানভাবে নিশ্চিত করা, নির্বাচনী অনিয়ম ও আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে সরকারি দলের প্রার্থী ও নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশনের উপযুক্ত ভূমিকা গ্রহণ ইত্যাদি।
ফলে কার্যত নির্বাচন কমিশন সব দল ও প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ছাড়া নির্বাচনের সময়ে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ, যেমন—পর্যবেক্ষক ও সংবাদমাধ্যমের জন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা; মোবাইলের জন্য ফোরজি ও থ্রিজি নেটওয়ার্ক বন্ধ; জরুরি ছাড়া মোটরচালিত যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা নির্বাচনের স্বচ্ছতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
গবেষণার সার্বিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করার মাধ্যমে নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া; নির্বাচনের সময় পর্যন্ত ধরপাকড় ও গ্রেপ্তার অব্যাহত রাখা, সরকারবিরোধী দলের নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা প্রদানসহ প্রার্থী ও নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও সহিংসতা নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছে। কোনো কোনো আসনে ক্ষমতাসীন দলের প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কাছ থেকে সরাসরি প্রচারণার জন্য সুবিধা আদায়সহ প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যের ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর প্রচারণায় অংশগ্রহণ এবং সরকারি সম্পদ ব্যবহার করে প্রচারণার দৃশ্যও দেখা যায়।
অন্যদিকে গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ৫০টির মধ্যে ৩৬টি আসনে বিরোধী দলের প্রচারে বাধা দানসহ ৪৪টি আসনে সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই দলীয় নেতাকর্মীদের নামে মামলা, পুলিশ বা প্রশাসনের হুমকি ও হয়রানি, প্রার্থী ও নেতাকর্মী গ্রেপ্তার এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী ও কর্মীর বিভিন্ন সময়ে ভয়ভীতি দেখানোর তথ্য পাওয়া যায়। এ ছাড়া গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১৯টি আসনে সহিংসতাসহ প্রার্থীদের নেতাকর্মীদের মধ্যে মারামারি, সরকারবিরোধী দলের প্রার্থীর সমর্থক ও নেতাকর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, হামলা, নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙচুর করা ও পুড়িয়ে দেওয়ার চিত্র দেখা যায়।
টিআইবি আরো জানা, তাদের গবেষণায় ৫০টির মধ্যে ৪১টি আসনে জাল ভোট; ৪২টি আসনে প্রশাসন ও আইন প্রয়োগকারী বাহিনীর নীরব ভূমিকা; ৩৩টি আসনে নির্বাচনের আগের রাতে ব্যালটে সিল; ২১টি আসনে আগ্রহী ভোটারদের হুমকি দিয়ে তাড়ানো বা কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা; ৩০টি আসনে বুথ দখল করে প্রকাশ্যে সিল মেরে জাল ভোট; ২৬টি আসনে ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করা; ২০টিতে ভোটগ্রহণ শুরু হওয়ার আগেই ব্যালট বাক্স ভরে রাখা; ২২টিতে ব্যালট পেপার শেষ হয়ে যাওয়া; ২৯টিতে প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে না দেওয়ার ঘটনা ঘটে।
একাদশ নির্বাচনে ভোটের শুরু থেকেই বিএনপি অভিযোগ করে যে আগের রাতে ব্যালটে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। ভোটের আগে সারা দেশে অসংখ্য ‘গায়েবি মামলা’ দিয়ে তাদের নেতাকর্মীদের এলাকাছাড়া করা হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান সে সময় বিবিসিকে বলেন, ‘এক ধরনের অভূতপূর্ব নির্বাচন হয়েছে, যার ফলে এই নির্বাচন অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য হিসেবে আলোচিত হচ্ছে।’
ওই নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়ার অবিশ্বাস্য ঘটনা সম্পর্কে ২০১৯ সালের ৩০ জুন তৎকালীন সিইসি কে এম নুরুল হুদা ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন ‘নির্বাচনে শতভাগ ভোট পড়া স্বাভাবিক নয়। তবে এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের করণীয় কিছু নেই। ভোটের পরই প্রিজাইডিং অফিসার কেন্দ্রভিত্তিক সব নিষ্পত্তি করেন। একীভূত ফল রিটার্নিং অফিসার আমাদের কাছে পাঠিয়ে দেন। তখন ওই বিষয়ে আমাদের কিছু জানায়নি; তাই এখন ইসির কিছু করার নেই।’
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন