হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ বিরতি চুক্তি কতটুকু টেকসই হবে !

 শাহাব উদ্দিন//
দীর্ঘ ৪৭০ দিন টানা গোলা ,বোমার আঘাতে বিদ্ধস্থ গাজাবাসীরা ১৯ শে জানুয়ারি ২০২৫ সালের ভোরে অন্যরকম সকাল দেখলো।কারন যুদ্ধ বিরতি চুক্তি হওয়ায় বোমা অথবা গোলার শব্দে ঘুম ভাংগেনি। হামাসের হাতে ইসরায়েলী তিন নারী বন্দীর মুক্তির মধ্যে দিয়ে শুভ সুচনা হয়। গাজায় দখলদার বাহিনীর হাতে অর্ধ লক্ষাধিক  নিহত এবং লক্ষাধিক আহত বিকালাংগ ফিলিস্তিনি। সমস্ত গাজা ধংস স্তুপে পরিনত হয়েছে। তারপর ও পৃথিবীর মানবতাবাদী মানুষ যুদ্ধ চায় না শান্তি চায়। দীর্ঘদিন থেকে কাতারের মধ্যস্ততায় যুদ্ধ বিরতির আলোচনা চলছিল। কিন্তু তা আলোর মুখ দেখছিল না। গত নভেম্বরের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী ওয়াদা ছিলো তিনি নির্বাচিত হলে মধ্যেপ্রাচ্যে এবং ইউক্রেন ,রাশিয়ার যুদ্ধ বন্ধের জন্য ভূমিকা পালন করবেন।
তিনি নির্বাচিত হওয়ার পর তার প্রশাসনের পক্ষথেকে এব্যাপারে যোগাযোগ করা হয়। এবং চুক্তি বাস্তবায়ন ও সংকট নিরসনে তার প্রশাসন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। উভয় পক্ষের এই ইতিবাচক সাড়া বিশ্বের শান্তি কামী  মানুষের প্রত্যাশার বহিঃপ্রকাশ ।এবং চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য উভয় পক্ষের উদ্দেশ্যে ট্রাম্প টুইটারে ধন্যবাদ জানান।
এদিকে এই চুক্তির কৃতিত্ব বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন ,এই চুক্তি তার সরকারের কুটনৈতিক সফলতা । কিন্তু গত ১৫ মাসের এই গনহত্যায় ইসরায়েলী প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামীন নেতানিয়াহুকে অস্ত্র এবং অর্থের চালান দিয়ে সাহায্য করায় তাকেও সমান দোষে দোষী বলে জনগণ মনে করে। তার এ ধরনের পররাষ্ট্র নীতির কারনে সারা বিশ্বে ইসরায়েলের মতো ,আমেরিকার ও ইমেজ সংকট দেখা যায়। বেনইয়ামীন নেতানিয়াহু মতো জো বাইডেন ও মানুষের চক্ষুশূল হয়েছেন। যার জলন্ত প্রমান গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির ভূম ধস পরাজয়। যা বাইডেন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ছিল সত:ফূর্ত গন বিপ্লব।
আমেরিকা ,কাতার ,,ও মিশরের মধ্যেস্ততায় চুক্তির শর্তাবলি হলো ,উভয় পক্ষের মধ্যে সিজ ফায়ার অর্থাৎ যুদ্ধ বন্ধ রাখতে হবে । গাজা ভূখণ্ডের মধ্যে থেকে ইসরায়েলী সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে । প্রথম দফায় ইসরায়েলী ৩৩জন জিম্মিকে হামাস মুক্তি দেবে । বিনিময়ে ইসরায়েল  কারাগার থেকে ১ হাজার ৯৩১জন ফিলিস্তিনি মুক্তি পাবে। এইভাবে ৪২ দিনের মধ্যে ছয়টি ধাপে চুক্তির বাস্তবায়ন হবে। এখনো হামাসের হাতে বন্দী ৯৪ জন  ইসরায়েলী জিম্মি। এবং ইসরায়েলের কাছে দশ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি বন্দী আছেন । বন্দী চুক্তি মুক্তির বিনিময়ে ফিলিস্তিনিরাও ইসরায়েল কারাগার থেকে মুক্তি পাবে । মানবিক সহায়তার জন্য প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক খাদ্যে ,ওষধ ,সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গাজায়  ঢুকতে পারবে । গাজার দায়িত্বে থাকবেন  ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আল আব্বাস। চতুর্থ ধাপে ,গাজা পুনর্গঠনের জন্য মিশরের নের্তৃত্বে কাজ চলবে । চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য কাতারের প্রেসিডেন্ট সকলের সহযোগিতা কামনা করেন ।
এই চুক্তিতে স্বাগত ও ধন্যবাদ জানান ,পোপ ফ্রান্সিস জাতিসংঘের  মহাসচিব অন্তেনিয় গুতেরেস সহ যুক্তরাজ্য ,জার্মান সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ। এবং ইসরায়েলী প্রেসিডেন্ট ,আইজেক হারজগ বলেন ,এই চুক্তি একটা সটিক পদক্ষেপ। এর মধ্যে দিয়ে অত্র এলাকায় শান্তি ও আমাদের জিম্মিদের মুক্ত করে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে আনতে পারবো।এভাবেই বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে অভিনন্দন ও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। হামাসের সামরিক শাখা কাসেম ব্রিগেডের প্রধান ,আবু ওবায়দা বলেন ,এই যুদ্ধ বিরতি চুক্তি আমাদের মহান ফিলিস্তিনি জনগণের কিংবদন্তি দৃড়তা ,গাজা উপত্যকায় বিগত ১৫ মাস ধরে বীরত্বপূর্ণ আমাদের প্রতিরোধ যুদ্ধের ফল। এই যুদ্ধ বিরতি বিশ্বময় শান্তি কামী ও মানবতাবাদী মানুষের অর্জন  "।মাতৃভূমি রক্ষার এই যুদ্ধে আত্মাহুতি দিয়ে ছেন  তাদের নেতা ইসমাইল হানিয়া ,,ইয়াহইয়া সিনওয়ার সহ অনেক। এবং হুতি বিদ্রোহী, হিজবুল্লা সহ যে সব যোদ্ধারা সহায়তা করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও সকল শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান।তিনি বলেন ,, ইসরাইল বাহিনী আমাদের প্রতিরোধ যুদ্ধে টিকতে না পেরে তারা বেপরোয়া ভাবে নারী ,শিশু,বৃদ্ধ,সহ অনেকে হত্যা ,এবং  অমানবিক নির্যাতন করে।
বোমার আঘাতে হাসপাতাল,,স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ,বাড়িঘর ,,রাস্তাঘাট সব স্থাপনা ধংস করে দেয়। গাজাকে মৃত্যুপুরী ,জলন্ত আগ্নেয়গিরিতে রুপান্তরিত করেছে। আমরা প্রতিফুটা রক্তের বদলা নেব। রক্তপিপাসু বেনইয়ামীন নেতানিয়াহু চেয়েছিল যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী করার মধ্যে দিয়ে  ফিলিস্তিন জাতিকে নি:শেষ করে ,তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে। আমরা তা ব্যর্থ করে দিয়েছি। এই যুদ্ধ বিরতির ফলে গাজার মানুষের মধ্যে আনন্দের বন্যা চলছে। খুশিতে ফিলিস্তিনিরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অনেকে ধংসস্তুপের উপর সেজদায় লুটিয়ে পড়তে দেখা যায়। নিজের ভিটে মাটিতে গিয়ে কোন চিহ্ন খুঁজে পাচ্ছেন না। পাচ্ছেন না তাদের কোন পরিবারের সদস্য। হয়তো কংক্রিটের নিছে চাপা পড়ে আছেন। পুরো এলাকা মৃত মানুষের গলিত লাশের গন্ধে বাতাস দূষিত হয়ে গেছে । তারপর ও গাজাবাসীরা নিজ ভূমিতে বেচে থাকার জন্য আশার আলোয় বুক বাধছেন । অন্যদিকে ইসরায়েল প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামীন নেতানিয়াহু এতদিন দম্ভভরে বলছিলেন,হামাসকে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত সেনা অভিযান চালিয়ে যাবেন। ফিলিস্তিন ,জর্ডান,লেবানন,সিরিয়া তাদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে আসছিলেন। এবং এই রাষ্ট্রগুলো নিজেদের দখলে নিয়ে আরব সাগর থেকে লোহিত সাগর পর্যন্ত বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছিলেন। ইতিমধ্যে তিনি  একটি মানচিত্র প্রকাশ করেন। যা নিয়ে আরব দেশগুলো ক্ষোভ প্রকাশ করে। তারা বলেন ,, ইসরাইলের এই পদক্ষেপ অন্যান্য দেশ গুলোর স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বর উপর নগ্ন আঘাত। এবং আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। এত হুমকি ধমকির পর হামাসের সাথে এই চুক্তি বেনইয়ামীন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বের দেউলিয়াত্বই প্রকাশিত হলো। শুধু তাই নয় ,তার সরকারের  কট্রোর উগ্রবাদী ডানপন্থী সমর্থক "উছমা এহুদদ পার্টির "নেতা "ইতামার বেনগাবির, জোট ছেড়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন ,হামাসের সাথে এই চুক্তি লজ্জাজনক আত্মসমর্থনের সমান। আমি এ সরকারে থাকবো না। যদি আবার তাদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয় আমি ফিরে আসবো। তিনি বলেন ,হামাস হলো সন্ত্রাসী ,এদেরকে যুদ্ধ করে বন্দী করেছি। কিন্তু এই চুক্তির কারনে আমরা তাদেরকে ছেড়ে দিচ্ছি,তা ভাবতে ও  পারিনা। তাদের  নেতৃত্বে  ইসরায়েলের রাস্তায় রাস্তায় চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে । এমনকি এই চুক্তির বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আদালতের শরনাপন্ন হলে সেখানে মামলা খারিজ হয়ে যায় । বেনইয়ামীন নেতানিয়াহু মন্ত্রী সভার অর্থমন্ত্রী বলেন ,এই চুক্তি আমাদের জন্য  ভূল এবং আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত । আমরা হামাস নির্মূল ,ও পুরো গাজার দখল নিয়ে আমাদের সরকার প্রতিষ্ঠা করবো । সন্ত্রাসীদের সাথে চুক্তি  আমাদের জন্য লজ্জা ও অপমানের । ইসরায়েলী সেনাবাহিনী আক্রমনের মাষ্টার মাইন্ড জেনারেল জোওরা ইয়র্ড,এক রেডিও সাক্ষাৎ কারে স্বীকার করেন,আমরা এই যুদ্ধ শুরু করেছিলাম একটা নিদিষ্ট সময় মাথায় নিয়ে ,কিন্ত ১৫ মাস হলো যুদ্ধ চলছে। হামাস প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। বরং হিজবুল্লা ,হুতি সহ অন্যান্য সশস্ত্র বাহিনীর সাথে আমরা বিভিন্ন ফ্রন্টে যুদ্ধে জড়িয়ে যাচ্ছি। এই যুদ্ধের শেষ আমরা দেখতে পাচ্ছি না। এ যেন কঠিন বাস্তবতা ও ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়েছি। চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বৈঠকে ২৪ জন মন্ত্রীর মধ্য ৮ জন পদত্যাগ করেন। সেই সভায় কয়েকজন মন্ত্রী ও সচিব  হাউমাউ করে কেদে বলেন ,এই ব্যর্থতা আমাদের কিন্তু এর বিকল্প নেই ,ইহা  খুবই প্রয়োজন। আজ যারা উল্লাসীত হয়ে হাসছে ,শিঘ্রই আমরা কান্নায় ভাসিয়ে দেব।
ইসরায়েলী প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামীন নেতানিয়াহুর উপর বিশ্ব নেতৃত্বের চাপ। বিশেষ করে নূতন প্রেসিডেন্ট একটা চমক দেখাতে  চেয়েছেন। আন্তর্জাতিক আদালতে বেনইয়ামীন নেতানিয়াহু সহ তার মন্ত্রী সভার কয়েকজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। পশ্চিমা সহ বিভিন্ন দেশে ইসরায়েল বাহিনীর কোন সদস্য গেলে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কারণে ও গ্রেফতারের মুখোমুখি হতে পারেন। বিশ্বব্যাপী ইসরায়েল একটা ঘৃনার রাষ্ট্র হিসাবে চিন্নিত হয়েছে। এবং তাদের সহযোগী  রাষ্ট্র হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইমেজ সংকটে জর্জরিত। গাজা প্রায় ধংস প্রাপ্ত। কিন্তু তাদের মিত্র সহ বিশ্ববাসী দেখলো জায়েনিষ্টরা তাদের নিজস্ব স্বার্থে কত বর্বর , অসভ্য, মানবতারিরোধী আচরণ করতে পারে। যা সদ্য মুক্তি প্রাপ্ত তিন ইহুদি নারী তাদের মুখে এবং চেহারায় সাক্ষী দিয়েছে। তারা বলেছেন , হামাস যোদ্ধারা তাদের প্রতি অত্যন্ত সদয় আচরন করেছেন। নিজের জীবন বাজিরেখে তাদের খাওয়া দাওয়া ,প্রান রক্ষায় যত্নশীল ছিলেন। উপহার সহ মুক্তি প্রাপ্ত তিন মহিলা হাসিমুখে তাদের আত্মীয় স্বজন ও বিভিন্ন মিডিয়ায় তার বর্ননা দেন। এটাই হলো যুদ্ধ বন্দীদের সাথে ইসলামের শিক্ষা। যুদ্ধের মধ্যে নিজের জীবন ,পরিবার ,দেশ বিপন্ন তারপর ও বন্দী শত্রুদের প্রতি এই সহানুভূতির আচরণ দেখে বিশ্ববাসী অবাক। আর অন্যদিকে ইসরায়েল কারাগার থেকে যারা মুক্তি পেয়েছেন ,,একজন পার্লামেন্ট মেম্বার সহ সবাই ছিলেন অনাহার ,অর্ধাহারে কংকালসার । নির্যাতনে জর্জরিত ভগ্ন শরীর। অনেকে ইসরায়েল কারাগারে তাদের ভয়াবহ নির্যাতনের বর্ননা দেন। জায়েনিষ্টরা বন্দীদের সাথে জেনেভা কনভেনশন অথবা তাদের ধর্মীয় রীতিনীতি নূন্যতম পালন করে নাই সেটাই স্পষ্ট।
জায়েনিষ্টরা তাদের নিজস্ব স্বার্থে বিশ্ব আইন কানুন ,বা ধর্মীয় বিধি নিষেধের তোয়াক্কা করে না। ১৫ মাস পর , এই ৪২ দিনের জন্য চুক্তি কতদিন কার্যকর থাকবে। একটা ই এখন  দেখার বিষয় । না  আবার আশাহত হবে  বিশ্ব বিবক ! কারন মধ্যেপ্রাচ্যে নিয়ে পৃথিবীর কালো শকুনদের লোলুপ দৃষ্টি সব সময় । তাদের পোষ্যপুত্র ইসরায়েল হলো দাবার গুটি। ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প  ইংগিতে বলেছেন ,গাজা রিভিল্ড এবং চুক্তি ভংগ হলে  তিনি ইসরায়েলের পক্ষেই থাকবেন । সুতরাং প্রভাতের সূর্য উদয় থেকে দিনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তারপর ও মানুষ আশাবাদী ,সকলের জন্য বাসযোগ্য একটা শান্তিময় পৃথিবী  হোক।                                       লেখক নিউইর্য়ক প্রবাসী কলামিস্ট ও রাজনৈতিক ।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন