বুলবুল আহমেদ, নবীগঞ্জ হবিগঞ্জ প্রতিনিধি:- সিলেটের কৃতি সন্তান শাহ এএমএস কিবরিয়া একজন অর্থনীতিবিদ, কূটনীতিক ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। শাহ আবু মুহাম্মদ শামসুল কিবরিয়া ১৯৩১ সালের ১ মে হবিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শাহ ইমতিয়াজ আলী সিলেট অঞ্চলে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসারে তিনি অগ্রগামী ছিলেন। শামসুল কিবরিয়া মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন ও ১৯৪৯ সালে সিলেট মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে বিএ (সম্মান) ও ১৯৫৩ সালে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় তিনি ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। এতে তাকে গ্রেফতার করে দেড় মাস জেল খানায় আটকে রাখা হয়।
শাহ এএমএস কিবরিয়া ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেন। তিনি বোস্টনের ফ্লেচার স্কুল অফ ল অ্যান্ড ডিপ্লোমেসি, লন্ডনে ব্রিটিশ ফরেন অফিসে কূটনৈতিক পরিষেবার জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং প্যারিসে ফরাসি ভাষার কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত শাহ কিবরিয়া কলকাতা, কায়রো, জাতিসংঘ মিশন, নিউইয়র্ক, তেহরান, জাকার্তায় ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক মিশনে দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি ইসলামাবাদে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়াশিংটন ডিসিতে পাকিস্তান দূতাবাসে কাজ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শাহ কিবরিয়া ১৯৭১ সালের ৪ আগস্ট ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাস থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেন এবং মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষনণাকরেন । ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ মিশন সংগঠিত করা এবং মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে তার সক্রিয় ভূমিকা ছিল । কিবরিয়া কংগ্রেসের স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং ওয়াশিংটনে সিনিয়র কলামিস্টদের সাথে লবিং করেছিলেন। যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রগতি, অধিকৃত বাংলাদেশের জনগণের অবস্থা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে মূল্যায়ন করতে তিনি একটি বুলেটিন জারি করেন।
স্বাধীনতার পর, এএমএস কিবরিয়া ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিষয়ক বিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে পররাষ্ট্র সচিব হন। ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে তিনি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং ফিজিতে হাই কমিশনার ছিলেন। জেনেভায় জাতিসংঘের ইউরোপীয় অফিসে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধিও ছিলেন। ১৯৭৮ সালে কিবরিয়া পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। সে সময় তিনি সার্কের জন্য প্রাথমিক ধারণাপত্রের খসড়া তৈরি করেন। ১৯৭৯ সালে ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (UNCTAD) এর ৭৭ টি প্রস্তুতি কমিটির নির্বাচিত চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালের ৩১ এপ্রিল পর্যন্ত পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮১ সালের মে মাস থেকে ১৯৯২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত তিনি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের পদ মর্যাদা সহ এশিয়া ও প্যাসিফিকের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ESCAP) নির্বাহী সচিবের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে কম্বোডিয়ার মানবিক ত্রাণ বিষয়ক জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধির অতিরিক্ত দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগে যোগ দেন। তাকে দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হয়। ১৯৯৪ সালে তিনি আওয়ামীলীগ সভাপতির রাজনৈতিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে যোগদান করেন এবং ২০০১ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। শাহ কিবরিয়া (হবিগঞ্জ-৩) আসন থেকে ২০০১ সালে জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
অর্থমন্ত্রী হিসাবে থাকাবস্থায় শাহ কিবরিয়ার ৫ বছর মেয়াদে বৃদ্ধ বয়সী ও বিধবাদের পেনশন প্রবর্তন, ছোট আকারের কৃষি ঋণের একটি বড় সম্প্রসারণ, স্বল্পমূল্যের আবাসন প্রকল্প, যুব কর্মসংস্থান কর্মসূচি এবং গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মতো অনেক নীতি দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল। এতে, বাংলাদেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতও। তিনি আইটি এক্সেসরিজ থেকে সব ধরনের আমদানি শুল্ক প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেন। ১৯৯৪ সালের বন্যার প্রভাব মোকাবেলায় কাউন্টার সাইক্লিক্যাল নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তার তত্ত্বাবধানে অর্থনীতিতে দ্রুত প্রবৃদ্ধি হয়েছিল (কৃষির নেতৃত্বে) দামের স্থিতিশীলতার উল্লেখ যোগ্য ডিগ্রি।
১৯৯৭ সালে ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (ESCAP) এর চেয়ারম্যান হন। ১৯৯৮ সালে ইন্টারন্যাশনাল ফান্ড ফর এগ্রিকালচারাল ডেভেলপমেন্ট (IFAD)- এর গভর্নিং কাউন্সিলের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিবরিয়া বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন। গবেষণা, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের বিকল্প চেয়ারম্যান ড.
শাহ কিবরিয়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে জাতীয় দৈনিকে কলাম লিখতেন। তিনি বাংলা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন মৃদু ভাষা (মৃদুভাষী) এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ছিলেন। তিনি চারটি বই লিখেছেন। ১৯৯৭ সালে মৃদু-ভাষণ, ১৯৯৯ সালে দ্য এমার্জিং নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার এবং বাংলাদেশ এট দ্য ক্রসরোডস চিত্ত জেঠা ভৈষ্যূন্য (যেখানে মন ভয়হীন)। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি শাহ এএমএস কিবরিয়া হবিগঞ্জে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন। ২০১০সালে আইটি আনুষাঙ্গিক শুল্কমুক্ত আমদানি ও ভূমিকার জন্য মরণোত্তর আইসিটি চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন।
বিগত ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকালে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ পরবর্তী এক জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন তৎকালীন (হবিগঞ্জ-৩) আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। এ ঘটনায় শাহ এএমএস কিবরিয়ার ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী প্রাণ হারান। এতে আহত হন কমপক্ষে শতাধিক নেতা কর্মী। এ ঘটনার রাতেই হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। এরপর দীর্ঘ তদন্ত শেষে সাড়ে ৯ বছর পর গত ২০১৪ ইংরেজী সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার তৃতীয় সম্পূরক অভিযোগ পত্রে নতুন ১১ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। এ অভিযোগ পত্রে সিআইডি'র চার্জশিটে আসামী হলেন, সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আলহাজ্ব জি, কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি শফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল আলম, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ ও হাফেজ ইয়াহিয়া। শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার বিলম্বে হতাশা ব্যক্ত করেন মামলার বাদী ও (হবিগঞ্জ-২) আসনের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান।
এ ব্যাপারে মামলার আসামিরা বিভিন্ন কারাগারে থাকা এবং সাক্ষীদের উপস্থিতি না হওয়ায় মামলার বিচারে বিলম্বে হচ্ছে বলে জানান।
এ ব্যাপারে সিলেটের পিপি অ্যাডভোকেট সারোয়ার আহমেদ আব্দাল বলেন, বর্তমানে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দুটি মামলার বিচার চলছে। এতে উভয় মামলায় ১৭৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ৪৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। আদালতে সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় দিনের পর দিন অতিবাহিত হচ্ছে। ফলে, এ মামলা দুটির কোন অগ্রগতি হচ্ছে না।
এদিকে, হতাশার শেষ নেই নিহতের আত্মীয়- স্বজন, আহতের আত্মীয় স্বজন সহ স্থানীয়দের। তবুও বুক ভরা আশা নিয়ে উক্ত ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার দেখতে চান সবাই। সব জটিলতার অবসান ঘটিয়ে চাঞ্চল্যকর এ মামলার বিচার অনতিবিলম্বে সম্পন্ন করা হবে বলে এখনও আশায় বুক বেধেঁ আছেন নিহতের পরিবার- পরিজন, আত্মীয় স্বজন সহ সাধারণ মানুষ।
অপরদিকে,
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াকে হত্যার মিশনে জড়িত ছিলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের ৩জন গুরুত্বপূর্ণ সাবেক এমপি আবু জাহির, মজিদ খান ও ডা. মুশফিক চৌধুরী ওই হত্যার মিশনে জড়িত ছিলেন। নিহত সাবেক মন্ত্রী'র পুত্র ড. রেজা কিবরিয়া এনিয়ে গুরুতর অভিযোগ করে বলেন, একটি অসমাপ্ত তদন্তের মাধ্যমে বিচার করার চেষ্টা করেছিল বিগত সৈরাচার আওয়ামীলীগ সরকার। এ মামলা থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে প্রকৃত অপরাধীদের! এমন দাবি করছেন তিনি। এ অবস্থায় বিচার নিয়ে হতাশা থাকলেও এখন একটি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে হত্যাকান্ডের বিচারটি আলোর মুখ দেখতে পারে বলে মনে করছেন নিহতদের পরিবার ও স্থানীয়রা।
নিহত শাহ এএমএস কিবরিয়ার পুত্র ড. রেজা কিবরিয়া আরো বলেন, বিগত ২০ বছর পার হলো আমার আব্বাকে গ্রেনেড হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি'র শরীরে প্রায় ৪০০ স্পিন্টার বিদ্ধ হয়। দুঃখ জনক হলেও সত্য যে, একটি ভাঙ্গা অ্যাম্বুলেন্সে আমার আব্বাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। তিনি পথিমধ্যেই মারা যান। আমরা দীর্ঘ ২০ বছর ধরে এ হত্যার বিচারের অপেক্ষা করছি। আওয়ামীলীগের আমলে কোনো সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। কারণ আওয়ামীলীগের অনেকেই এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন, এটি আমরা জানতে পেরেছি। আওয়ামীলীগের গুরুত্বপূর্ণ সাবেক প্রভাবশালী এমপি আবু জাহির, মজিদ খান ও ডা. মুশফিক চৌধুরী জড়িত ছিলেন। এ হত্যাকান্ডের জন্য টাকা দিয়েছিলেন সালমান এফ রহমান। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমার আব্বার সাথে তাদের শত্রুতা ছিল। সালমান এফ রহমান তার ব্যাংকের দুর্নীতি ও শেয়ার মার্কেটের কেলেঙ্কারি'র জন্য আমার আব্বার ওপর ক্ষেপে ছিলেন। সে কারণেই তিনি পুরো ফান্ডিং করেছেন। হত্যাকারী সবাই শেখ হাসিনার খুব কাছের লোক। তাই সুষ্ঠু তদন্ত বা সুষ্ঠু কোনো বিচারও হয়নি। একটি অসমাপ্ত তদন্তের মাধ্যমে সুষ্ঠু বিচার হতে পারে না। আমরা এখন আশা করছি এবার হয়তো আমার আব্বা হত্যান্ডের বিচার হবে। আমার বিশ্বাস আজ না হয় কাল আমার আব্বা হত্যাকারীদের সুষ্ঠু বিচার দেখতে পারবো। আমরা সবাই সে বিচারের অপেক্ষার প্রহর গুনছি।
তিনির স্ত্রী আসমা কিবরিয়া ও তাদের দাম্পত্য জীবনে ১ পুত্র অর্থনীতিবিদ রেজা কিবরিয়া ও ১ কন্যা নাজলি কিবরিয়া বোস্টান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন