হুসনা খান হাসি ||
সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার (গর্ভাশয়ের মুখের ক্যান্সার) বিশ্বব্যাপী নারীদের জন্য একটি গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি। যদিও এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং চিকিৎসাযোগ্য, সামাজিক কলঙ্ক, সচেতনতার অভাব, এবং চিকিৎসা বৈষম্যের কারণে লক্ষ লক্ষ নারী এখনও এই রোগের যথাযথ চিকিৎসা পান না। আমার এই লেখা বিশ্ব ক্যান্সার দিবসকে কেন্দ্র করে। বিশ্ব ক্যান্সার দিবস ২০২৪-এর থিম “Close the Care Gap” বা “চিকিৎসা বৈষম্য কমানো” আমাদের এই অসাম্য দূর করার আহ্বান জানায় (২০২৫ সালের বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের থিম এখনও নির্ধারিত হয়নি)। এই প্রবন্ধে সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারের চিকিৎসা বৈষম্যের কারণ, পরিসংখ্যান এবং সম্ভাব্য সমাধানের উপায় বিশ্লেষণ করা হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার নারী সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারে আক্রান্ত হন এবং ৩ লাখ ৪০ হাজারের বেশি নারী মারা যান। এর মধ্যে ৯০% মৃত্যুই নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে ঘটে, যেখানে চিকিৎসা সেবা সীমিত এবং সামাজিক কুসংস্কার ব্যাপক। উন্নত দেশে, নিয়মিত Pap smear টেস্ট ও HPV টিকা গ্রহণের ফলে আক্রন্তের হার কমে এসেছে, কিন্তু উন্নয়নশীল দেশগুলোর নারীরা এখনও এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারের চিকিৎসা বৈষম্যের মূল কারণ গুলো হচ্ছে:
১- আর্থ-সামাজিক অসমতা -অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর নারীরা প্রায়শই স্বাস্থ্যসেবার বাইরে থেকে যান। বিশ্বব্যাপী ৬০% নারী যারা সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারে মারা যান, তারা দরিদ্র দেশগুলোর বাসিন্দা। উন্নত চিকিৎসা ব্যয়বহুল হওয়ায়, অনেকেই সময়মতো স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন না।
২- সামাজিক কলঙ্ক ও কুসংস্কা -সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার সাধারণত হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (HPV) সংক্রমণের মাধ্যমে হয়, যা যৌন সংক্রমণজনিত (STI) ভাইরাস। ফলে অনেক সমাজে এই ক্যান্সারকে যৌন জীবনধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দেখা হয়। অনেক নারী কুসংস্কার ও সামাজিক লজ্জার কারণে স্ক্রিনিং করাতে রাজি হন না। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভারতের ৪০% নারী সামাজিক লজ্জার ভয়ে Pap smear পরীক্ষা করান না।
৩- সচেতনতার অভাব - HPV টিকা ও Pap smear পরীক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞতা চিকিৎসার প্রধান বাধা। আফ্রিকান অঞ্চলে ৭০% নারী জানেন না যে, এই ক্যান্সার প্রতিরোধযোগ্য। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে HPV টিকা সহজলভ্য হলেও, অসচেতনতার কারণে গ্রহণের হার কম।
৪- স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর দুর্বলতা - নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে উন্নত স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা সুবিধার অভাব স্পষ্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, উন্নত দেশে ৮০% নারী ৩৫-৪৫ বছর বয়সে একবার হলেও Pap smear করান, কিন্তু নিম্ন আয়ের দেশে এই হার মাত্র ১৯%। চিকিৎসার অভাবে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় না হওয়ায় মৃত্যুহার বেশি।
সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয়:
১- বিনামূল্যে HPV টিকা প্রদান - HPV ভ্যাকসিন সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। অস্ট্রেলিয়াতে HPV ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক করার পর আক্রান্তের হার ৭৪% কমেছে। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে এই টিকা সরবরাহ করা জরুরি।
২- জনসচেতনতা বৃদ্ধি - সামাজিক কুসংস্কার ভাঙতে গণমাধ্যম, সামাজিক প্রচারাভিযান ও স্বাস্থ্য শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। উদাহরণস্বরূপ, রুয়ান্ডা সরকার সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার সম্পর্কে জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু করে, যার ফলে টিকা গ্রহণের হার ৯৩% এ উন্নীত হয়েছে।
৩- কম খরচে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা - WHO-এর মতে, যদি ৭০% নারী নিয়মিত স্ক্রিনিং করান, তাহলে সার্ভাইক্যাল ক্যান্সারজনিত মৃত্যু ৩০ বছরে ৫০% হ্রাস পাবে। উন্নত স্ক্রিনিং পদ্ধতি সহজলভ্য করতে কম খরচের Pap smear ও ভিজুয়াল ইনস্পেকশন অ্যাসিটিক অ্যাসিড (VIA) পরীক্ষার প্রচলন বাড়াতে হবে।
৪ -স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন - গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে গাইনি বিশেষজ্ঞ ও নার্স প্রশিক্ষণ, স্ক্রিনিং সেন্টার স্থাপন, ও টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে সেবা সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। বাংলাদেশে সম্প্রতি ৫০টি উপজেলায় VIA স্ক্রিনিং চালু করা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে সারাদেশে বিস্তৃত করা যেতে পারে।
৫- পুরুষদের অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ- HPV শুধু নারীদের নয়, পুরুষদেরও সংক্রমিত করে। পুরুষদেরও HPV টিকা প্রদান এবং নারীদের চিকিৎসার জন্য সহযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলা জরুরি।
অবশেষে সর্বশেষে সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ, কিন্তু চিকিৎসা বৈষম্য এবং সামাজিক কলঙ্কের কারণে হাজারো নারী অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর শিকার হন। বিশ্ব ক্যান্সার দিবস ২০২৪-এর থিম “Close the Care Gap” আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, সকল নারী সমান চিকিৎসা সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখেন। টিকা, স্ক্রিনিং ও সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা এই বৈষম্য কমিয়ে আনতে পারি। সরকার, স্বাস্থ্য সংস্থা ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে একযোগে কাজ করতে হবে, যেন কোনো নারী চিকিৎসার অভাবে জীবন না হারান।
সার্বিকভাবে, যদি আমরা সচেতনতা বৃদ্ধি, টিকা নিশ্চিতকরণ এবং সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বৃদ্ধি করতে পারি, তবে সার্ভাইক্যাল ক্যান্সার আর কোনো নারীর মৃত্যুর কারণ হবে না। আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, “সকল নারীর জন্য সমান চিকিৎসার সুযোগ নিশ্চিত করা”।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন