বাংলাদেশের মত আর কোথাও এতো অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতি করে না
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
সামান্য কোন ইস্যুতেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি অবস্থান, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া কিংবা সংঘর্ষের ঘটনায় মধ্যযুগীয় বর্বরতার নজির মনে করায়। শিক্ষার্থীরা এমনটা কেন করে? বিশ্বের কোথাও ছাত্রসমাজের মধ্যে যে চরিত্র নাই তা ঢাকার কলেজগুলো এবং দু'চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোথা থেকে এসেছে? কথায় কথায় ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কিছু কলেজের শিক্ষার্থীদের রাস্তা অবরোধ, ভাঙচুরসহ যাবতীয় আগ্রাসনকে সুস্থ আচরণ ভাবার সুযোগ আছে? বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের শিক্ষার্থী তথা অনার্স-মাস্টার্সে অধ্যয়ণরতদের একাংশের সুযোগ পেলেই ধ্বংস-প্রলয় চালানোর চরিত্র কোথা থেকে সংক্রমিত হলো? বিশ্বের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজ, এমনকি বুয়েট, বিইউপি কিংবা এমআইএসটির শিক্ষার্থীদের সেধে কারো সাথে সংঘর্ষে জড়ানোর কথা কোনোদিন শুনেছেন?
কলেজগুলোতে পড়াশোনার চিত্র ও চরিত্র খুবই নাজুক। কলেজগুলোর অনার্স পর্যায়ের বিভাগগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য যতসংখ্যক আসন বরাদ্ধ তা মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার প্রবল অন্তরায়। বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া উচ্চতর ক্লাসসমূহে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ২০-৩০% এর মধ্যে। সারাবছর ক্লাস না করেও যে সিলেবাসে পরীক্ষার আগের রাতে বই কিনে পড়ে পাশ করে অনার্স-মাস্টার্স পাশ করে সার্টিফিকেট পাওয়া যায়, সে সকল শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার বিকল্প হিসেবে কোন একটা কাজকে তো বেছে নিতেই হবে! শিক্ষার্থীরা আপাতত পথে-ঘাটে দাদাগিরি বেছে নিয়েছে। কথায় কথায় ঢাকা শহর অচল করে দেওয়া, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর করা কিংবা নিজেদের মধ্যে রাত-দিনভর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া করে সময় কাটানো! একজন শিক্ষার্থী কোথাও আক্রান্ত হলে সেখানে আলোচনা কিংবা ক্ষতিপূরণ আদায়ের পথে সমাধান না করে গোষ্ঠীগতভাবে এসে হামলে পড়া, সব দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিয়ে কোথাও সাড়াশি আক্রমন করা- অনেকটাই জাহালিয়্যাতের চরিত্র। শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যার সমাধান পদ্ধতি টোকাইদের মত হলে তো মুশকিল!
বাংলাদেশের মত আর কোথাও এতো অধিক সংখ্যক শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতি করে না এবং 'সহমত ভাই' বলে না। শিক্ষার্থীদের কাজ কী?- যদি স্পেসিফিক করা হয় তবে বলতে হবে, 'ছাত্রানং অধ্যায়নং তপঃ।' অথচ আজকের শিক্ষার্থীরা তাদের মূখ্য কাজকে গৌণ করে বাকি সব কাজ প্রতাপের সাথে পালন করছে। তাদের ক্লাস পার্টি আছে, বর্ণিল র্যাগ ডে পালন করছে কিংবা পুনর্মিলনীর আয়োজন হচ্ছে অথচ শিক্ষকের ক্লাসে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নাই! নোট করা নিয়ে, লাইব্রেরিতে বসা নিয়ে কিংবা ভালো রেফারেন্স সংগ্রহ করা নিয়ে তাদের মধ্যে কোন আগ্রহ নাই। আশির দশকের ঢাকা কলেজের শিক্ষার মান এবং সাম্প্রতিক সময়ের ঢাকা কলেজের শিক্ষার পরিস্থিতি কোন তুলনায় অঙ্কিত করবো? সারা বাংলাদেশের স্কুল-কলেজগুলো প্রায় কাছাকাছি চরিত্র বহন করছে। অথচ কোনদিন শুনেছেন ক্যাডেট কলেজের শিক্ষার্থীরা কোথাও রাস্তা অবরোধ করে মারামারি করেছে? তাদের এই সময়ই নাই। আইন-কানুন কড়া, নিয়ম শৃঙ্খলা শতভাগ মানতে হচ্ছে। যাদের দিনের পড়া দিনে শেষ করতে হয়, সব কাজ সময়ের মধ্যে করতে হয় তাদের মারামারি, লড়ালড়ি কিংবা হাতাহাতির সুযোগ থাকে না।
খবরে দেখলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রো-ভিসি ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের অপমান করেছে। এর সমাধান আলোচনায় নাই? এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মুখোমুখি হতে হবে কেন? তাতে যোগ দিতে হবে কেন ঢাবি অধিভুক্ত বাকি ছয় কলেজের শিক্ষার্থীদের? দেশের মেধাবীদের এই চরিত্র শোভনীয় নয়, এমন আচরণ আকাঙ্ক্ষিত নয়। অথচ অল্প ক'মাস পূর্বে এই সকল শিক্ষার্থী ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতাপ ও প্রভাবশালী তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাদেরকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করেছে। সেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে এতো অল্পদিনে অনৈক্য সুলক্ষণ নয়। অতীতেও দেখেছি, তৎকালীন সরকারের ছাত্র সংগঠনের প্রকাশ্য বিরোধিতা করার যখন কেউ ছিল না তখন তারা নিজেদের মধ্যে মারামারিতে নিজেদের মত্ত রেখেছিল। সাধারণ ছাত্রদের সাথে সৃষ্টি হওয়া সেই ছাত্রসংগঠনটির দূরত্বে একটি সরকারের পতন ঘটেছে। বর্তমান শিক্ষার্থীরাও ইতিহাস থেকে শিখবে না?
মোটাদাগে যদি বলতে হয়, আমাদের শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুমে, পড়াশোনায় নাই মানে তারা সঠিক পথে নাই। জীবনের গন্তব্যে পৌঁছাতে তারা বিপথ ধরেছে। এর পরিণতি ভয়ানক হবে। রাষ্ট্রও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মারামারি করা, চাঁদাবাজি করা কিংবা দখলবাজি করা- এসব শিক্ষার্থীরা আসল কাজ তো নয়-ই বরং ঐচ্ছিক কাজও নয়। শিক্ষার্থীদের একমাত্র কাজ হচ্ছে শৃঙ্খলা মেনে পড়াশোনা করা। শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্রীয় সংকটে রাস্তায় নামবে, আপৎকালীন প্রয়োজনের সময়ে এগিয়ে আসবে। তারা তাদের দাবির কথা বলবে এবং দাবি আদায় করবে- তবে সেটা শৃঙ্খলার মাধ্যমে। শিক্ষকদের অপমান-অপদস্থ করা, নিজেদের মধ্যে মারামারি করা- এসব নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র ও চরিত্র। নিজেদের মধ্যে মারামারি করে, ধাক্কাধাক্কি করে কেউ কখনোই জেতেনি বরং হারিয়ে গেছে জীবন। ঝরে গেছে সম্ভাবনাময় ফুল। যারা কোন পক্ষের এজেন্ডা নিয়ে কলহ করেছে তারা শেষমেষ কিছুই পায়নি। না হয়েছে ভালো ক্যারিয়ার, আর না পেরেছে নেতা হতে।
শিক্ষার্থীরা অবিলম্বে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে, ক্লাসরুমে এবং পড়ার টেবিলে ফিরলে নিজেদের মঙ্গল হবে। শিক্ষার্থীদের নৈতিকভাবে সম্পন্ন করার একহাজার কাজের তালিকা করলেও তাতে মারামারিকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না। কিন্তু তাদের জন্য যদি একটি-দুটি নিষিদ্ধ কাজের তালিকা করা হয় তবে তাতে শুরুতেই মারামারির কথা থাকবে। অনার্স-মাস্টার্সে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা যথেষ্ট ম্যাচিউরড। তাদের অনেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা করার মতো বোধবুদ্ধি রাখেন। তারা যদি নিজেদের ভালো না বুঝেন, রাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করতে না পারেন, তাদের শত্রু ও বন্ধু আলাদা করতে না পারেন কিংবা তাদের উচিত-অনুচিত শ্রেণিবদ্ধ করতে ব্যর্থ হন তবে সেটা আহাম্মকি আচরণ হবে। কিছু কাজের খেসারত আজীবন দিতে হয়। শিক্ষার্থীদের বর্তমান আগ্রাসন ও উগ্রতা, পরস্পরের বিরুদ্ধে শত্রুতা-অনৈক্য এবং ভালোভাবে পড়াশোনা না করা- এই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত একদিন না একদিন পূরণ করতেই হবে।
শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে সরকার একটু কঠোর হোক। শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাসরুমে ফেরানো জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সাত কলেজের অধিভুক্তি ঐতিহাসিক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। এর খেসারত ঢাকাবাসীকে কতকাল দিতে হবে কে জানে! পান থেকে চুন খসলেই যে প্রজন্ম রাস্তা অবরোধ করে, ভাঙচুর করে নিজেদের/রাষ্ট্রের সম্পদ তাদের বোধ-চেতনা জাগ্রত করার চিকিৎসা সরকারের কাছে থাকলে তা দেখানো দরকার। শিক্ষার্থী শব্দের বিকল্পই হচ্ছে পড়াশোনা। তবে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা, ক্লাসরুমে উপস্থিতি এবং আচরণ- তারা সঠিক গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলছে সেটা ইঙ্গিত করে না। রবিবার রাতে ঢাবি ও ঢাকা কলেজসহ সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে সেটার কালিমা দূর করতে বহুদিন লাগবে। সমাধান যত ত্বরিতগতিতে হবে মঙ্গল তত নিকটে আসবে। শিক্ষার্থীরা কোন গুজবে না মেতে পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্ব স্ব ক্যাম্পাসে ফিরে গেলে সেটা বুদ্ধিবৃত্তিক সিদ্ধান্ত হবে।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন