হুসনা খান হাসি ||
সমাজে রঙভেদ বা বর্ণবাদের সমস্যা আজও বিদ্যমান, যেখানে গায়ের রঙের উপর ভিত্তি করে মানুষকে বিচার করা হয়। বিশেষত, গায়ের রঙ এবং লজ্জা একটি গভীর সম্পর্ক তৈরি করে, যা ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস, মানসিক অবস্থা, এবং সামাজিক অবস্থানকে প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশে বা বিশ্বব্যাপী বহু মানুষ তাদের গায়ের রঙের কারণে বিভিন্ন নেতিবাচক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন, যা অনেক সময় লজ্জা, মানসিক চাপ এবং আত্মসম্মানহীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একবিংশ শতাব্দীতেও বিশ্বের অধিকাংশ সমাজে ত্বকের রঙের ভিত্তিতে বৈষম্য ও কালারিজম উপস্থিত থাকলেও, এই বিষয়টি খুব একটা আলোচিত হয় না কিংবা আমরা এতে খোলামেলা আলোচনা করতে চাই না। কিছু সমাজে এখনও গাঢ় ত্ত্বককে একটি কলঙ্ক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
“এটি শুধু পক্ষপাতিত্ব নয়, এটি বর্ণবাদ,” বলেন মানব উন্নয়ন বিভাগের অধ্যাপক সুনীল ভাটিয়া। তিনি ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টে ত্বকের রঙের ভিত্তিতে বিদ্যমান গভীর অভ্যন্তরীণ বর্ণবাদ এবং সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
গায়ের রঙ এবং কলঙ্কের মধ্যে সম্পর্কটি একবিংশ শতাব্দীতেও সমানভাবে দৃশ্যমান। এ ধরনের বর্ণবাদ শুধু সামাজিক স্তরে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এর প্রভাব পড়তে থাকে মানুষের মনোজগৎেও। দক্ষিণ এশিয়াসহ অনেক দেশে গায়ের রঙ নিয়ে বিদ্বেষ প্রচলিত রয়েছে। শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ বা গাঢ় ত্বকের ব্যক্তিরা অনেক ক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। এই বৈষম্য শুধু চাকরি বা শিক্ষা ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং ব্যক্তিগত জীবনেও তাদের বিভিন্ন ধরনের অপমান এবং অবমাননা সহ্য করতে হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলিতে গায়ের রঙের কারণে এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ৪৫% নারী তাদের গায়ের রঙের কারণে আত্মবিশ্বাসহীনতার শিকার হন এবং প্রায় ৩৮% নারী মানসিকভাবে লজ্জিত হন (Source: University of Dhaka, 2020)। এভাবেই গায়ের রঙের প্রতি সামাজিক মনোভাব আত্মসম্মানে আঘাত হানতে পারে, এবং এ থেকে যে মানসিক চাপ সৃষ্টি হয় তা অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
গায়ের রঙের ভিত্তিতে মানুষের প্রতি বিচারব্যবস্থা সমাজের একটি গভীর সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলচ্চিত্র, টেলিভিশন শো, বিজ্ঞাপন এবং সংবাদপত্রগুলিতেও গায়ের রঙের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। এমনকি কিছু ভারতীয় সিনেমায় সুন্দরী নায়িকাদের চিত্রায়িত করার জন্য তাদের গায়ের রঙকে সাদা করতে বিশেষ প্রচেষ্টা নেয়া হয়। এটি সমাজে একটি ভুল বার্তা দেয় যে, শ্বেতাঙ্গ হওয়া উচিত বা গায়ের রঙ যতটা ফর্সা হবে, ততটাই আকর্ষণীয় ও সম্মানজনক।
কিছু কিছু পরিবারের সদস্যরা অনেক সময় মনে করেন যে, গায়ের রঙ ফর্সা হলেই একজন নারীর বিয়ে হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এই বিশ্বাস অনেক সমাজেই জনপ্রিয়, যার ফলে নারীরা তাদের গায়ের রঙের কারণে মানসিকভাবে অবহেলিত হয়ে পড়েন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, গায়ের রঙ নিয়ে লজ্জা বা অনুশোচনা নারীদের আত্মবিশ্বাসের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে তাদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সমস্যা তৈরি হয়।
গায়ের রঙের কারণে অনেকেই নিজের প্রতি আস্থাহীনতা অনুভব করেন, যা তাদের মধ্যে এক ধরনের লজ্জা সৃষ্টি করে। এই লজ্জা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে নানা রকম নেতিবাচক ফলাফল ঘটাতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব নারী নিজেদের গায়ের রঙ নিয়ে লজ্জা অনুভব করেন, তারা সাধারণত নিজের অনুভূতিগুলি ব্যক্ত করতে ভয় পান এবং তাদের আত্মবিশ্বাস কমে যায়। ২০১৭ সালে এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩৪%
গাঢ় ত্বকের নারী তাদের রঙের কারণে সঙ্গীদের থেকে এক ধরনের দূরত্ব অনুভব করেন এবং ৫৭% নারী তাদের বাইরের রূপের তুলনায় অন্তর্নিহিত গুণাবলীর প্রতি বেশি মনোযোগ দেন না (Source: Harvard Medical School, 2017)।
অন্যদিকে, গায়ের রঙ নিয়ে লজ্জা অনুভব করার ফলে ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও গভীর প্রভাব পড়ে। যেমন, গবেষণায় দেখা গেছে যে, রঙভেদের শিকার হওয়া ব্যক্তির মধ্যে ডিপ্রেশন এবং মানসিক চাপের পরিমাণ সাধারণ মানুষের তুলনায় অনেক বেশি (Source: Journal of Social Issues, 2019)।
গায়ের রঙের বৈষম্যের একটি প্রকৃত উদাহরণ হতে পারে ভারতীয় শোবিজ জগত। ভারতীয় টেলিভিশন ও সিনেমায় গায়ের রঙের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল এবং এখনও কিছুটা বিদ্যমান। ২০০৫ সালে “Fair and Lovely” নামে একটি ব্র্যান্ডের স্কিন কেয়ার ক্রিম বাজারে প্রবেশ করে, যার বিজ্ঞাপনগুলো গায়ের রঙ সাদা করতে উৎসাহিত করেছিল। এই বিজ্ঞাপনগুলো সমাজে এমন একটি ধারণা প্রচার করেছে যে, গায়ের রঙ যতটা সাদা হবে, ততটাই আপনি সুন্দর, আকর্ষণীয় এবং মূল্যবান। এই মডেলিং কালচারের মধ্য দিয়ে অনেকেই তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন এবং নিজেদের গায়ের রঙ নিয়ে লজ্জা অনুভব করতে শুরু করেছেন। তবে ২০২০ সালের পর, “Fair and Lovely” নামটি বদলে “Glow and Lovely” রাখা হয়, যা কিছুটা হলেও রঙভেদের বিরুদ্ধে একটি প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবে দেখা গেছে।
সমাধান: সচেতনতা এবং সামাজিক পরিবর্তন
সমাজে গায়ের রঙ এবং লজ্জার প্রভাব কমাতে হলে প্রথমে রঙভেদ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রতিটি মানুষের গায়ের রঙই তাদের মূল্য নির্ধারণ করে না। আমাদের সমাজে যেন একে অপরের প্রতি সমান শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকে, তার জন্য সম্মান ও সমতা প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। শিক্ষা, সংস্কৃতি, মিডিয়া এবং পরিবার, এই সব জায়গায় সচেতনতা গড়ে তোলার মাধ্যমে গায়ের রঙ নিয়ে লজ্জা বা কলঙ্ক কমানো সম্ভব।
আমাদের প্রচলিত সামাজিক সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে হবে, যাতে মানুষ গায়ের রঙের উপর ভিত্তি করে অন্যদের বিচার না করে। এটি সমাজে বৈষম্য, দুঃখ, এবং মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক হবে। প্রতিটি ব্যক্তির জন্য তাদের আত্মবিশ্বাস এবং সুখী জীবন নিশ্চিত করার জন্য এই ধরনের সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সবশেষে, গায়ের রঙ এবং লজ্জা সম্পর্কিত সমস্যা শুধুমাত্র মানসিক চাপের কারণ নয়, এটি সমাজের একটি গভীর সংস্কৃতি, যার প্রভাব অনেক সময় ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। এই রঙভেদে অনিয়মিততা, বৈষম্য এবং মানসিক চাপ বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে, সচেতনতা এবং সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে আমরা একটি সঠিক পথ তৈরি করতে পারি, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি তার গায়ের রঙের প্রতি গর্ব অনুভব করবেন এবং আত্মবিশ্বাসী হয়ে জীবনযাপন করতে পারবেন।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন