রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবে রূপ দিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন চেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, দ্রুত সংস্কারকাজ শেষ করা হবে, যাতে নির্বাচনের পথে এগোনো যায়। এ লক্ষ্যে রিপোর্ট নিয়ে রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব চাপিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। আমরা কেবল সুপারিশগুলো নিয়ে এসেছি, আমরা শুধু সাচিবিক কাজ করে দিলাম। এটা আমার কাজ নয়, এটা আপনাদের কাজ, যেহেতু আপনারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন।’
গতকাল শনিবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সেখানে সরকার এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এ ধরনের অভিমত উঠে আসে। বিকেল ৩টায় বৈঠক শুরু হয়ে চার ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, আলোচ্যসূচির বাইরে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল জাতীয় নির্বাচনের বিষয়টি উত্থাপন করে। বেশির ভাগ দল জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের বিরোধিতা করে তাদের বক্তব্য তুলে ধরে।
গণ অধিকার পরিষদ, জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে। বেশির ভাগ দলই এ বছরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছে। ইসলামী আন্দোলন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন চেয়েছে। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ এবং এর নেতাদের বিচারের দাবি জানিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপি, জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), নাগরিক ঐক্য, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদসহ ২৬টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রায় ১০০ নেতা অংশ নেন।
এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিরাও বৈঠকে ছিলেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকের শাসনের অবসান ঘটে। এরপর দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারে প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনগুলোর বিভিন্ন সুপারিশ বিবেচনা এবং জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করবে ঐকমত্য কমিশন।
কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হবে কতটুকু সংস্কার দ্রুত করতে হবে আর কতটুকু পরে করা যাবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতেই ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন করবে সরকার। এজাতীয় সনদের ভিত্তিতে হবে নির্বাচন।
দীর্ঘসূত্রতা চাই না, অল্পদিনের মধ্যে কাজ শেষ করব : আলী রীয়াজ
বৈঠক শেষে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান আলী রীয়াজ বলেন, আজকের বৈঠক সংলাপ ছিল না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রক্রিয়া কী হবে, সে বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করা হয়েছে। মূলত এটাকে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। ৩২ জন কথা বলেছেন।
তিনি বলেন, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের বক্তব্যে যেটা স্পষ্ট হয়েছে, সেটা হলো তারা মনে করে, জাতীয় ঐক্য রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তারা দৃঢ়তা প্রকাশ করেছে। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ও অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার প্রক্রিয়াকে সাহায্য-সহযোগিতা করবে, অংশগ্রহণ করবে।
আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমরা আশা করছি, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজ এখন শুরু হবে। আমরা আলাদাভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলব, জোটগতভাবেও কথা বলব এবং এক পর্যায়ে হয়তো আশা করছি, সবাইকে একত্র করে আমরা আবার ফিরে আসব। এই প্রক্রিয়াটার আমরা দীর্ঘসূত্রতা করতে চাই না, অল্পকিছু দিনের মধ্যেই এটা করতে পারব বলে আশা করছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, ছয় মাসের কম সময়ে সম্ভব হলে, রাজনৈতিক দলগুলোর আগ্রহ আছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও মনে করে, যত দ্রুত সম্ভব, কিছুটা সময় লাগবে অগ্রসর হতে।’
ন্যূনতম ঐকমত্য শেষে দ্রুত নির্বাচন চায় বিএনপি
সংস্কারের মাধ্যমে ন্যূনতম ঐকমত্য তৈরি করে অতিদ্রুত জাতীয় নির্বাচন হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘আজ প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম সভায় মিলিত হয়েছিলেন। এই সভায় রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে তিনি আহবান জানিয়েছেন, সংস্কার কমিশনগুলো যে রিপোর্টগুলো দিয়েছে তার প্রতিটির ওপরে আলাপ-আলোচনা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে কথা বলবে কমিশন এবং একটা ঐকমত্যে পৌঁছার চেষ্টা করা হবে। সেটাই আজকের বৈঠকের মূল কথা।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি আশা করে, খুব দ্রুত এই সংস্কারের যে ন্যূনতম ঐকমত্য তৈরি হবে এবং সেটার ওপর ভিত্তি করে অতিদ্রুত জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’
জাতীয় নির্বাচন না স্থানীয় সরকার নির্বাচন—এই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা পরিষ্কার বলেছি যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সবার আগে হতে হবে। তারপর স্থানীয় সরকার নির্বাচন হবে।’
দ্রুত নির্বাচন চায় জামায়াতও
বৈঠক শেষে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘আমরা বলেছি যে সংস্কার প্রয়োজন। সেই সংস্কারে আমরা ঐকমত্য হই, তারপর যথাশিগগির সম্ভব নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে উনারা নির্বাচন করবেন। আমরা সেটা দেখছি।’
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন জামায়াতের এই নেতা। তিনি বলেন, সব ইতিবাচক সিদ্ধান্তে জামায়াতে ইসলামী সমর্থন জানাবে। তিনি বলেন, ‘আমরা বলেছি, এই সংস্কার কমিশন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছার পর যাতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যথাসম্ভব সেই প্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য।’
ঐকমত্য কমিশন সংস্কার নিয়ে বিস্তারিত বই আকারে দেবেন উল্লেখ করে সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘সেটা পর্যালোচনা করে জামায়াতে ইসলামী এবং যে টিম (সংস্কার কমিশনগুলো) আছে সরকারের, তাদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক হবে, মতবিনিময় হবে। সেখানেই জামায়াতের মূল সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’
অন্যান্য দল
এবি পার্টির সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘স্থানীয় কিংবা জাতীয় যে নির্বাচনই করা হোক, নির্বাচন করার মতো প্রশাসনিক কোনো কর্তৃত্ব সরকারের নেই। কর্তৃত্ব না থাকলে কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠুভাবে করা যাবে না।’ তিনি বলেন, ‘আপনাদের কোনো আলোচনায়, ছবিতে, কোথাও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো অবদান ঠাঁই পায় না। তাহলে কিভাবে জাতীয় ঐকমত্যের জন্য সব দলের সহযোগিতা চান?’
বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল আ. লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে একমত : নুরুল হক নুর
গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো কিছু কথা বলেছে। বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এই কথা বলেছে যে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের প্রশ্নে মোটামুটি আমরা সবাই একমত। আমরা চেয়েছিলাম আজকের মিটিং থেকে আওয়ামী লীগের বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত হোক।’
এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ বলেন, এখন স্থানীয় নির্বাচন করা যাবে না। তাহলে সারা দেশে সহিংসতা হতে পারে। এতে জাতীয় নির্বাচন করার পরিবেশ থাকবে না।
আ. লীগের বিচারে হস্তক্ষেপ করলেই প্রতিবাদ : সারজিস
আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসরদের বিচারে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করেন না, এই মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। তিনি বলেন, যদি কেউ হস্তক্ষেপ করে তাহলে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ঐক্যবদ্ধভাবে আবার প্রতিবাদ শুরু করবে।
নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে। নিষিদ্ধের প্রক্রিয়ায় যেতে হবে। এই ক্ষেত্রে যদি তারা তাদের নেতৃত্ব দিতে না পারে, এই তরুণ প্রজন্মের কাছে তাদের সামনে যুগের পর যুগ এই দায়বদ্ধতা বহন করতে হবে।’
বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতিতে আ. লীগ অপ্রাসঙ্গিক : হাসনাত আবদুল্লাহ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ‘৫ আগস্ট ছাত্র-নাগরিক সিদ্ধান্ত দিয়েছে বাংলাদেশের পরবর্তী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অপ্রাসঙ্গিক। আমরা আজকে সব রাজনৈতিক দল ঐকমত্য হয়েছি বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অপ্রাসঙ্গিক। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দল থেকে বিভিন্ন মানুষ হারিয়ে যায়, একইভাবে আওয়ামী লীগও অপ্রাসঙ্গিক হয়েছে। আমরা সরকারকে আইনি উদ্যোগ নিয়ে নিষিদ্ধ করে এবং পরবর্তী কোন প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ যেন ফাংশন না করে, সেটা বলেছি। প্রথম ধাপ হিসেবে তাদের নিবন্ধন বাতিলের দাবি করেছি।’
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, ‘আমরা বলেছি টেস্ট ম্যাচের মাধ্যমে যেতে হবে, যেখানে ধৈর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের ৫৩ বছরের অসমাপ্ত কাজগুলো রয়েছে, সেগুলো সংস্কার কমিশনের মাধ্যমে সমাপ্ত করতে হবে।’
তিনি বলেন, গণপরিষদ ও জাতীয় নির্বাচন এবং সংস্কার একসঙ্গে চলতে পারে।
বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন প্রধান বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক এবং দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন প্রধান ইফতেখারুজ্জামান।
বৈঠকে বিএনপি মহাসচিব ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। প্রতিনিধিদলের অন্যরা হলেন জমির উদ্দিন সরকার, আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সালাহউদ্দিন আহমদ ও হাফিজ উদ্দিন আহমেদ।
এ ছাড়া বৈঠকে মোস্তফা জামাল হায়দারের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামী, অলি আহমদের নেতৃত্বে এলডিপি, মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বে নাগরিক ঐক্য, এস এম আলতাফ হোসেন ও সুব্রত চৌধুরীর নেতৃত্বে গণফোরাম, জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বে গণসংহতি আন্দোলন, সাইফুল হকের নেতৃত্বে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, মাওলানা সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানীর নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন, মাওলানা আবদুল বাছিদ আজাদ ও আহমেদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বে খেলাফত মজলিস, নুরুল হক নুরের নেতৃত্বে বাংলাদেশ গণ অধিকার পরিষদ, খন্দকার লুৎফর রহমানের নেতৃত্বে জাগপা, ফরিদুজ্জামান ফরহাদের নেতৃত্বে এনপিপি, আন্দালিব রহমান পার্থর নেতৃত্বে বিজেপি, নুরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাসদসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা অংশ নেন।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন