মাতৃভাষার জন্য জীবন দেওয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি এনে দিতে আমাদের আত্মত্যাগ করতে হয়েছে অনেক। জাতির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অপরিসীম। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের ভিত রচিত হয়।
শুক্রবার (২১ ফেব্রুয়ারি) মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
লিখিত বক্তব্যে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রাষ্ট্রভাষা বাংলা- এই আন্দোলন বাঙালির মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষার জন্য সূচিত হলেও এর মূল চেতনাটি ছিল স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। তা ছিল বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির আন্দোলন, তাই বাঙালির কাছে একুশ মানে মাথা নত না করার দৃঢ় প্রত্যয়। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি তাই শুধু বেদনার্ত অতীতকে স্মরণ করে অশ্রুবিসর্জনের দিন নয়, বরং এক অবিনাশী প্রেরণা, সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বীজমন্ত্র।
তিনি বলেন, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে মাতৃভাষার চেতনা ও মর্যাদা রক্ষার প্রেরণা ও এ চেতনার সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিকতার সূত্রে ২০০১ সালের ১৫ মার্চ ঢাকায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। বিশ্বের সব মাতৃভাষার সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও গবেষণার ইতিবৃত্তকে লক্ষ্য করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট তার যাত্রা শুরু করে।
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, মাতৃভাষা যে কোনো নৃগোষ্ঠীর ইতিহাস, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির বাহক। মাতৃভাষার সঙ্গে সব মানুষের আত্মার সম্পর্ক। মাতৃভাষার পর মানুষ যত ভাষাই আত্মস্থ করুক না কেন, সেসব নতুন ভাষায় যতই পারদর্শিতা অর্জনই করুক না কেন, মাতৃভাষাকে তার হৃদয়ের গভীরতা থেকে সরাতে পারে না।
তিনি বলেন, পৃথিবীর প্রায় সব দেশে নানান দেশের নানান ভাষার কিংবা হাতে গোনা কয়েকটি দেশের কিছু মানুষ নাগরিকত্ব গ্রহণ করে কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করে। নতুন দেশের ভাষা তাদের দৈনন্দিন জীবনে চব্বিশ ঘণ্টার ভাষায় পরিণত হয়ে যায়, কিন্তু তবু সে ভাষা তার মাতৃভাষায় পরিণত হয় না। তারা নিজেদের মধ্যে একত্র হলেই উৎসাহ সহকারে নিজেদের মূল ভাষায় ফিরে যায়, তাদের মূল ভাষার সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে নেয় নিজেদের অজান্তেই।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, যেসব শহরে তাদের মাতৃভাষাবাসীর সংখ্যা বেশি তাদের শহরের মেয়র, সিটি কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে অনায়াসে নির্বাচিত হয় তারা। তাদের শহরে তারা নিজেদের মাতৃভাষা নির্দ্বিধায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে। তাদের মাতৃভাষায় সরকারি দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনা করে, তাদের ভাষাভাষী পুলিশ শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করে। অথচ শহরের গণ্ডি ছাড়ালেই তারা আবার তাদের নতুন ভাষায় সাবলীলভাবে ফিরে যায়। শহরের নতুন নাগরিকদের নিয়ে পুরোনো নাগরিকদের মনে কোনো ক্ষোভের সৃষ্টি হয় না।
তিনি বলেন, একটি নতুন ভাষা শিখলেই পুরনো ভাষায় দুর্বল হয়ে পড়বে এই ধারণার কোনো ভিত্তি নেই। পৃথিবীর বহু দেশে একই নাগরিক সাবলীলভাবে কয়েকটি ভাষায় কথা বলবে এটা খুবই স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়। তারা শৈশব থেকে নানান ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। স্কুলে পড়ার সময় প্রত্যেক ছাত্রকে অন্তত একটি ভিন্ন ভাষা শেখা বাধ্যতামূলক করা হয়। ছাত্ররাও আনন্দ সহকারে সেটা করে থাকে। ইংরেজি শিখলেই বাংলা ভুলে যেতে হবে এমন কোনো চিন্তা তাদের কারও মাথায় আসে না।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা দ্রুত গতিতে নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করে যাচ্ছি। এর জন্য মূলত নিত্যনতুন প্রযুক্তি প্রধানত দায়ী। প্রযুক্তির প্রাধান্যের সঙ্গে আসে ভাষার প্রাধান্য। যে দেশের প্রযুক্তি পৃথিবীতে প্রাধান্য অর্জন করতে থাকবে তার সঙ্গে প্রাধান্য অর্জন করতে থাকবে প্রযুক্তিদাতা দেশের ভাষা। সারা পৃথিবী এই ভাষা শেখার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে।
তিনি বলেন, স্পুটনিক যখন মহাকাশে উড়লো সারা পৃথিবী রাশিয়ান ভাষা শেখার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়লো। যে স্কুলে, যে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাশিয়ান ভাষা শেখানো হয় না সে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছাত্রদের এবং অভিভাবকদের উৎসাহ হারিয়ে ফেললো। যখনই চীন প্রযুক্তিতে এগিয়ে আসলো- চীনা ভাষা শেখার ধুম লেগে গেলো। যে দেশ পৃথিবীতে নেতৃত্ব দেবে পৃথিবী সে দেশের ভাষার দিকে ঝুঁকে পড়বে- এটাই নিয়ম। যে দেশের কিছু দেবার নেই সে দেশের ভাষাতেও পৃথিবীর আগ্রহ নেই অথবা থাকলেও নিম্ন পর্যায়ে থাকবে। প্রযুক্তি ছাড়াও যে কোনো দিক থেকে একটি জাতি নেতৃত্ব দিতে পারলে সে দেশের ভাষার প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বেই— সে ভাষা যত জটিলই হোক না কেন। জাতি এগোলে ভাষা এগোয়, ভাষার সম্মান বাড়ে। নিজ ভাষার নিবেদিত প্রাণ প্রচারকর্মী হওয়া সত্ত্বেও জাতির কাছ থেকে পৃথিবীর ভান্ডারে কিছু দেবার না থাকলে ভাষার প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস আরও বলেন, ভাষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির সঙ্গে সাহিত্য, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান- সরাসরি জড়িত। আমরা যখন মাতৃভাষায় কথা বলি তখন যেন মনে রাখি মাতৃভাষা মানুষের প্রাথমিক ভাষা। সেই ভাষা প্রথম শ্রবণে যতই রূঢ় মনে হোক না কেন তা একদিন তার প্রাথমিক স্তর পার হয়ে বহু দেশের বহু মানুষের অত্যন্ত নমস্য ভাষায় পরিণত হতে পারে। যদি সে ভাষা পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় কৌশলগত ভূমিকা দখল করে নিতে পারে।
জিবি নিউজ24ডেস্ক//
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন