ফেব্রুয়ারির উচ্ছ্বাস, বছরের বাকি সময়ের উদাসীনতা: ভাষা শুধু স্মরণের নয়, চর্চার বিষয়

হুসনা খান হাসি ||

ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের মধ্যে ভাষা নিয়ে বিশেষ উচ্ছ্বাস দেখা যায়। শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া, আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সব মিলিয়ে এক আবেগময় পরিবেশ তৈরি হয়, ভাষার প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধাবোধের প্রকাশ ঘটে।। ভাষার প্রতি এই শ্রদ্ধাবোধ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ, তবে প্রশ্ন থেকেই যায়, এই অনুভূতি কি কেবল এক মাসের জন্য? ভাষা আন্দোলনের চেতনা কি শুধুই স্মরণের বিষয়, নাকি তা প্রতিদিনের চর্চার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার বিষয়?

আমাদের ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র এক দিনের ঘটনা নয়, এটি একটি দীর্ঘ সংগ্রামের ফল। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী যখন বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়, তখনই শুরু হয় এই লড়াই। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকেই প্রাণ দিয়েছিলেন, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার পায়। তাদের আত্মত্যাগের কারণেই আমরা আজ বাংলায় কথা বলতে পারি, বাংলায় পড়তে ও লিখতে পারি। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হলো, আমরা কি সেই ভাষার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে পারছি?

প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আসলেই শহীদদের স্মরণ করি, বাংলা ভাষার গৌরবগাথা শুনি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে ভাষার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু ফেব্রুয়ারির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পরই কি আমরা ভুলে যাই ভাষার মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব? আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ভাষার প্রতি যত্নশীল থাকার প্রবণতা কতটুকু?

-অফিস-আদালতের নথিপত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসেনি।বিজ্ঞাপনে, বিলবোর্ডে, এমনকি বই-পুস্তকেও অনেক সময় বাংলা বানানের ভুল দেখা যায়।
-সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, সব জায়গায় বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীনতার ছাপ স্পষ্ট। ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষা তো দূরের কথা, বাংলা ও ইংরেজির সংমিশ্রণ ঘটিয়ে এমন এক ভাষা তৈরি করা হচ্ছে, যা বাংলার প্রকৃত রূপকে বিকৃত করছে। অনেকে মনে করেন, ইংরেজি জানলেই যেন আধুনিকতা প্রমাণ হয়, তাই নিজেদের ভাষার প্রতি একধরনের উদাসীনতা দেখা যায়। ভাষার প্রতি প্রকৃত ভালোবাসা কেবল ফেব্রুয়ারির আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না। বরং সারা বছর ধরে মাতৃভাষার সঠিক চর্চা, বিশুদ্ধ ব্যবহার এবং যথাযথ মর্যাদা রক্ষা করতে হবে।

বিদ্যালয়, পরিবার ও সমাজ, সব স্তর থেকেই ভাষা ব্যবহারের প্রতি সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আত্মপরিচয় তার ভাষার মধ্যেই নিহিত থাকে। তাই ভাষা আন্দোলনের চেতনা শুধু ফেব্রুয়ারির জন্য নয়, প্রতিদিনের জন্য। ভাষার প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা প্রকাশ পায়, যখন আমরা বাংলাকে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযথভাবে ব্যবহার করি, সংরক্ষণ করি এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার গৌরবময় ঐতিহ্য তুলে ধরি।

শুধু ভাষা দিবস পালন করলেই ভাষার প্রতি দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, বরং ভাষার সঠিক চর্চার জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করতে হবে।

ভাষার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে আমাদের নানা দায়িত্ব ও করণীয় রয়েছে। এর জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:

১- আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ভাষার সঠিক ও বিশুদ্ধ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।প্রাত্যহিক কথাবার্তা, লেখালেখি, প্রশাসনিক কাজ, গণমাধ্যমের ভাষা, সবক্ষেত্রেই শুদ্ধ বাংলা ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

২- শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা ভাষার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। শিক্ষার্থীদের বাংলা বানান ও ব্যাকরণ শেখানোর পাশাপাশি তাদের বাংলায় সৃষ্টিশীল লেখালেখির অভ্যাস গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা উচিত।

৩- ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষার আরও বিকাশ প্রয়োজন। বাংলা টাইপিং, অনুবাদ সফটওয়্যার, বাংলা কনটেন্ট তৈরি ও প্রচার বাড়াতে হবে।

৪- শুধু একুশে বইমেলায় গিয়ে বাংলা বই কেনাই যথেষ্ট নয়, সারাবছর বাংলা সাহিত্য পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। নাটক, গান, সিনেমা ও অন্যান্য শিল্পমাধ্যমেও বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার প্রতি নজর দেওয়া দরকার।

৫- বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলেও এখনো অনেক সরকারি দপ্তর, আদালত ও অফিসে ইংরেজির আধিপত্য রয়ে গেছে। প্রশাসনিক কাজকর্মে বাংলার ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

একটি জাতির সংস্কৃতি, ইতিহাস ও আত্মপরিচয় তার ভাষার মধ্যেই নিহিত থাকে। তাই ভাষা আন্দোলনের চেতনা শুধু ফেব্রুয়ারির জন্য নয়, প্রতিদিনের জন্য। ভাষার প্রতি সত্যিকার ভালোবাসা প্রকাশ পায়, যখন আমরা বাংলাকে আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যথাযথভাবে ব্যবহার করি, সংরক্ষণ করি এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তার গৌরবময় ঐতিহ্য তুলে ধরি।

ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষা ও আত্মপরিচয়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। তবে এ স্মরণ যেন শুধু এক মাসের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং সারাবছর বাংলা ভাষাকে যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়ার মাধ্যমে প্রকৃতভাবে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো সম্ভব।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন