মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানী। একটি নাম, একটি জীবন্ত ইতিহাস।
রাজু আহমেদ ||
আমরা কি পছন্দ ও চিন্তায় স্বাধীন হয়েছি? মানে যেমন স্বাধীনতা চেয়েছিলাম তেমন স্বাধীনতা পেয়েছি? যাচাই করার কড়ি পেয়ে গেছি।
স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত ব্যক্তিদের দিয়েই স্বাধীনতার যৌক্তিকতা ও যথার্থতা যাচাই করে দেখি। যাদেরকে পুরস্কারের জন্য বাছাই করা হয়েছে সেই মানুষগুলো এমন স্বীকৃতির জন্য যোগ্য কিনা? আসুন, দেখি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানী। একটি নাম, একটি জীবন্ত ইতিহাস। তেলিয়াপাড়ার চা বাগান থেকে যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধকালীন রণাঙ্গনের সেই কঠিন দিনগুলোতে সমগ্র বাংলাদেশকে প্রথম চার এবং পরবর্তীতে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে তৎকালীন বিশ্বের শক্তিধর সেনাবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর কৌশলগত অবস্থানের কারণেই স্বাধীনতার স্বপ্নের বাস্তব হয়েছিল। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫৪ বছর পরে হলেও বাংলা মাটির সেই সূর্য সন্তান এই বছর স্বাধীনতা পুরস্কার পাচ্ছেন। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের কিছুটা ঋণ বোধহয় শোধ করার সুযোগ পেলাম।
বিজ্ঞানী অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম। তিনি কী নন? বাংলাদেশকে বিশ্ব-দরবারে উপস্থাপন ও সম্মানজনক অবস্থানের নেপথ্যের নায়ক তিনি। ধ্রুপদী ব্যক্তিত্বের অধিকারী অধ্যাপক নজরুল ইসলাম একাধারে বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিশ্বতত্ত্ববিদ।
তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত “দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স” তার একটি সুবিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ। এ বছর তাকে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে মনে হচ্ছে আমরা চিন্তা ও পছন্দের স্বাধীনতার পথে স্বকীয়ভাবে হাঁটার যোগ্যতা অর্জন করেছি।
ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া একজন নক্ষত্র। তিনি আমেরিকায় জন্ম নিলে বিলগেটস, ইলন মাস্ককে ছাড়িয়ে যেতেন। নানান সীমাবদ্ধতার মাঝেও বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার চিত্র বদলে দিয়েছেন। শিক্ষা ও গবেষণায় ব্র্যাকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি র্যামন ম্যাগসেস পুরস্কার পেলেও এতোদিনে আমরা তাকে সেভাবে সম্মানিত করিনি কিংবা করতে পারিনি! সেই ঋণের অনেকটাই এবার আদায় হচ্ছে। আবেদ স্যারের নামে যাচ্ছে স্বাধীনতা পুরস্কার। কবরে শুয়ে শুয়ে মৃতরা আনন্দিত হতে পারে?
যদি জীবন্ত কিংবদন্তির কথা বলি তবে বাংলার আকাশে বদরুদ্দীন ওমর জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে ৯৩ বছরের যুবকটি ধারাবাহিকভাবে ধ্যানীর ভূমিকায় ছিল। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাস অপূর্ণ থেকে যাবে যদি তাকে সরিয়ে রাখা হয়। তিনি ২০২৫ এ স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন- এজন্য গর্ব অনুভব হচ্ছে। অন্তত এবারের পুরস্কার অযোগ্যদের হাতে ওঠেনি।
আল মাহমুদ সম্পর্কে নতুন করে বলার মতো কোনো গল্প নাই। বাংলা কবিতার আকাশে অন্যরা মিটমিটে তারা। তারাসমূহ অপূর্ণ যদি সেখানে চাঁদ না থাকে। আল মাহমুদ কবিতার জগতে যেন পূর্ণ চাঁদ। একখণ্ড মুগ্ধতা বাগিয়ে নেওয়ার কারিগর। রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে যে পরিমাণ অবহেলা এই মানুষটিকে করা হয়েছে তাতে জাতিগতভাবে কবির কাছে সম্মিলিত স্বরে ক্ষমা চাওয়া উচিত। 'মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে' ফেলা কবির নামের কাছে এবারের স্বাধীনতা পুরস্কার পৌঁছাবে- শুনতেই মনটা ভালো হয়ে গেছে। যোগ্যদের কাছেই যাক যোগ্যতম সম্মান। প্রিয় আল মাহমুদ, আপনার সন্তুষ্টির কথা খোদার কাছে বলবেন।
নকশাকার নভেরা আহমেদ কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের সহ নকশাকার হিসেবে বাঙালির মানসপটে চির ভাস্বর হয়ে আছে। ভাস্কর নভেরা আহমেদ দেশে-বিদেশে অসংখ্য কাজে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পকে আধুনিকায়নে নভেরা আহমেদের নাম বহুলভাবে উচ্চারিত। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী স্বাধীনতা পুরস্কারে নভেরা আহমেদরা নক্ষত্রের আলোকপ্রাপ্ত।
বাংলাদেশে শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনের যদি তিনজন মহৎপ্রাণকে স্মরণ করা হয় সেখানে আজম খানকে রাখতেই হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্র্যাক প্লাটুন থেকে শুরু করে পপ সংগীতের মঞ্চে- সর্বত্র আজম খানের অবদান ও সম্মান আকাশচুম্বী। পপ সম্রাটের কণ্ঠে বাংলা গানের শ্রেষ্ঠ গীতগুলি অলঙ্কারিত ও ঝঙ্কারিত হয়েছে। যা কিছু প্রিয় তার মধ্যে আজম খান আছে। সেই মানুষটিকে পুরস্কার মানে পুরস্কারকেই সম্মানিত করা।
শহিদ আবরার ফাহাদ। ভারতের নীতি বিরোধিতার কারণে যে যুবককে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে সেই বীরের কবরের কাছে স্বাধীনতা পুরস্কার পৌঁছাতে পারা মানে পুরস্কারকেই মহিমান্বিত করা। আবরার ফাহাদের পরিবার পুরস্কারকে গ্রহণ করবে না বরং পুরস্কারই আবরার ফাহাদের স্মরণে তাঁর পরিবারকে বরণ করবে। আবরারদের জীবন উৎসর্গেই নতুন বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সম্মান শহিদ আবরার ফাহাদ পাবেন- সেটাই তো প্রাপ্য ও আকাঙ্ক্ষিত। সাত গুণীজনের সাথে আবারকে যুক্ত করে স্বাধীনতা পুরস্কারের ঘোষণার মাধমে গোটা পুরস্কারকে পূর্ণতার পরম স্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
১৮ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশ। এখানে অসংখ্য গুণী মানুষের জন্ম হয়েছে। অনেক গুণী মানুষ জীবিত আছেন যারা স্ব স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তির যোগ্য। তবে পুরস্কারের সংখ্যা সীমিত। মৃত ও জীবিত যে আটজনকে এবার স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে তারা সবাই এ জাতির সোনার সন্তান। কেউ তাদের কৃতিত্ব, অবদান ও যোগ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলবে- প্রশ্নই আসে না। অথচ এই নিকট অতীতেও কত বিতর্কিত মানুষ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পুরস্কারের জন্য মনোনীত হতো! কত অযোগ্যরা পেতো কত বড় বড় সম্মান। তখন লজ্জিত অপমানিত হতো যোগ্যরা! যোগ্যকে বঞ্চিত করা মানেই কিন্তু যোগ্যতার অবমাননা করা।
আমরা এমন স্বাধীনতাই চেয়েছিলাম যেখানে যোগ্যতায় যোগ্যতমরা স্বীকৃতি পাবে। একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত ব্যক্তিদের দেখেই বুঝেছি- দেশ সঠিক পথে চলছে। এই চল্ ধারাবাহিক হোক। আমরা দর্শকের কাতারে দাঁড়িয়ে বারংবার সমস্বরে হাততালি দিতে চাই। যোগ্য মানুষকে সম্মানিত করার এই প্রয়াস যাতে কোনোভাবেই থেমে না যায়। পুরস্কারের জন্য মনোনীতদের জন্য আগাম আন্তরিক অভিনন্দন।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন