হুসনা খান হাসি ||
বাঙালি নারীরা শ্বশুরবাড়িতে সাধারণত নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন, তবে এটি ব্যক্তিভেদে এবং পরিবারভেদে ভিন্ন হতে পারে। কিছু পরিবারে নববধূকে ভালোবাসা, সম্মান ও সহানুভূতির সঙ্গে গ্রহণ করা হয়, যেখানে শ্বশুর-শাশুড়ি ও অন্যান্য সদস্যরা তার প্রতি সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখান। এতে নতুন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো তুলনামূলক সহজ হয়, এবং তিনি পারিবারিক বন্ধনকে দৃঢ় করতে সক্ষম হন। তবে অন্যদিকে, কিছু পরিবারে নারীদের প্রতি কঠোর মনোভাব প্রদর্শন করা হয়, যেখানে তাদের ওপর বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও মানসিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে নববধূকে নিজের জায়গা প্রতিষ্ঠা করতে এবং নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বেশ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। সুতরাং, একজন বাঙালি নারীর শ্বশুরবাড়ির অভিজ্ঞতা অনেকাংশেই নির্ভর করে সেই পরিবারের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি এবং পারস্পরিক সম্পর্কের ধরনগুলোর ওপর।
বিয়ের পর অনেক মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতে অন্যায় দোষারোপের শিকার হতে হয়। তাদের ভুল না থাকলেও সংসারের সব দোষ তাদের ওপর চাপানো হয়। স্বামী যদি পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন, তবুও দোষ বউয়ের, কারণ সে তাকে আগলে রাখতে পারেনি। স্বামী যদি মদ বা সিগারেটের নেশায় আসক্ত হন, সেটাও বউয়েরই দায়, কারণ সে একটু চেষ্টা করলে নাকি স্বামীকে সঠিক পথে আনতে পারত! এমনকি স্বামী রোজা না রাখলেও বা নামাজ আদায় না করলেও দোষ পড়ে বউয়ের ওপর। বলা হয়, “তুমি এতদিনেও শেখাতে পারলে না?” কিংবা “তুমি পড়লেই সে দেখে দেখে শিখে নিতে পারতো!
সংসারের প্রতি স্বামীর উদাসীনতা কিংবা দায়িত্বহীনতা, সব কিছুর জন্যই বউকে দোষী করা হয়, যেন তার দায়িত্ব শুধু স্বামীকে বদলে দেওয়া। বউ চাকরি করলে শ্বশুরবাড়ির অনেকে বলেন, “সংসারটা লাটে উঠবে!আবার বউ যদি চাকরি না করে, তখন প্রশ্ন ওঠে, “সংসারে উন্নতি হবে কিভাবে অথবা সংসারের খরচাদি চলবে কিভাবে?” স্বামীর নানা খারাপ অভ্যাস, মাদকাসক্তি, নারী আসক্তি, মানষিক ও শারীরিক ভাবে নির্যাতন করা, এমনকি স্বামীর শরীরে রক্ত শূন্যতা, আর্টারি ব্লকড, দাঁত পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ঢেঁকুর তোলা পর্যন্ত অযথাই সব দোষ বউয়ের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। কিছু কিছু পরিবারে বউকে কষ্ট দেওয়াকে যেন এক ধরনের গর্বের বিষয় মনে করা হয়, ঠিক যেমন চাল কুমড়াকে কাঁটাচামচ দিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়।
অথচ প্রশ্ন হলো, যদি সবকিছু শেখানোর দায়িত্ব বউয়েরই হয়, তাহলে সেই ছেলেকে তার পরিবার বা মা-বাবা জীবনের এতগুলো বছর কি শিখিয়েছেন? জন্মের পর থেকে কৈশোর, তারুণ্য, এই দীর্ঘ সময় জুড়ে তার ব্যক্তিত্ব, মূল্যবোধ, দায়িত্ববোধ গড়ে তোলার দায়িত্ব কি শুধুই উপেক্ষিত ছিল? কেন পরিবার তাকে সংসারের দায়িত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমানাধিকারের মূল্যবোধ শেখানোর প্রয়োজন বোধ করেনি? কেন এই ধারণা সমাজে বদ্ধমূল যে বিয়ের পর স্ত্রীই স্বামীর সমস্ত ভুল-ত্রুটি শুধরে দেবে, তাকে দায়িত্বশীল মানুষ করে তুলবে? সংসারের প্রতি স্বামীর উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতা, পরিবারে অংশগ্রহণের অভাব, এসব কিছুর জন্যই সবসময় স্ত্রীকে দোষী করা হয়, যেন তার একমাত্র কাজ স্বামীকে মানুষ করে তোলা! অথচ সম্পর্ক তো পারস্পরিক বোঝাপড়া, সহযোগিতা আর সমান দায়িত্বের ওপর ভিত্তি করে টিকে থাকে। তাহলে কেন শুধুমাত্র একজনের কাঁধেই এই বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়?
আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত কিছু কিছু পরিবারে গৃহবধূদের ওপর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, যা কখনো কখনো চরম বিপর্যয় ডেকে আনে। এসব নির্যাতনের ঘটনা কেবল একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এটি সমাজের সকল স্তরেই দেখা যায়, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত, সব শ্রেণির মধ্যেই এমন পরিস্থিতি বিদ্যমান। এই ধরণের সহিংসতা শুধু ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সমস্যা নয়; বরং এটি নারীদের নিরাপত্তা, সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে এক গভীর সামাজিক সংকটের ইঙ্গিত দেয়। সমাজে নারীদের প্রতি চলমান এই সহিংসতা রোধে সচেতনতা বৃদ্ধি, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং পারিবারিক মূল্যবোধের পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি।
এ ধরনের মানসিকতা আর কোনোভাবেই চলতে দেওয়া উচিত নয়। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার এখনই উপযুক্ত সময়। নারীদের প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য ও অবজ্ঞার অবসান ঘটানো জরুরি। পরিবার ও সমাজে তাদের সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে এবং সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলার মানসিকতা তৈরি করতে হবে।
বিশেষ করে, শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের উচিত নববধূকে পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গ্রহণ করা, তাকে যথাযথ মর্যাদা দেওয়া এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া। তাকে যেন বোঝা বা বাইরের কেউ হিসেবে না দেখা হয়, বরং ভালোবাসা ও সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করা হয়।
এ ছাড়া, নারীদের আর্থিক ও সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নারীদের ক্ষমতায়িত করে, যা তাদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হলে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন আনতেই হবে।
এটি স্পষ্ট যে, বাঙালি নারীদের শ্বশুরবাড়ির অভিজ্ঞতা তাদের প্রতি পরিবারের মনোভাব এবং পারস্পরিক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। যদিও কিছু পরিবারে সহানুভূতি ও সহযোগিতা দেখা যায়, অন্যদিকে অনেক পরিবারে নারীদের প্রতি অপ্রত্যাশিত চাপ ও কঠোর মনোভাব থাকে। বিশেষত, কিছু পরিবারে নারীকে শ্বশুরবাড়ির সব দোষ এবং সমস্যা মোকাবেলার জন্য দায়ী করা হয়, যা তার ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। এই ধরনের মানসিকতা শুধুমাত্র নারীদের প্রতি অবিচারই নয়, বরং সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধা।
পরিবার এবং সমাজে নারীর সম্মান এবং মর্যাদা নিশ্চিত করতে শিক্ষা, সচেতনতা এবং সমানাধিকারের ধারণা প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। নারীদের আর্থিক ও সামাজিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে, তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ বাড়ানোও অপরিহার্য। সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য সকল স্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে, বিশেষ করে শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের উচিত নববধূকে ভালোবাসা, সহানুভূতি এবং মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করা। শুধুমাত্র পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমতার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি সুন্দর এবং সুস্থ পরিবার গঠন সম্ভব।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন