প্রজাপতির মতো: বাংলাদেশের অদেখা সৌন্দর্য ও সম্ভাবনার গল্প

gbn

নিজাম এম রহমান FRSA ||

আজ সকালে আমি একটি অসাধারণ ছবি পেয়েছি এমন একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির কাছ থেকে, যাঁকে আমি বহুদিন ধরে শ্রদ্ধা করে আসছি। তিনি শুধু বাংলাদেশি কমিউনিটির একজন পথপ্রদর্শকই নন, বরং যুক্তরাজ্যসহ পুরো বিশ্বে বাংলাদেশিদের সম্মান ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। ছবিটি ছিল একটি প্রজাপতির, যার পাখায় ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের পতাকার রঙিন রূপ।

ছবিটির দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো—এই প্রজাপতির মতো আমরাও কি নিজেদের সৌন্দর্য ও শক্তি বুঝতে পারি? প্রজাপতি জানে না তার পাখা কতটা রঙিন, কতটা মনোমুগ্ধকর। সে উড়ে বেড়ায়, কিন্তু নিজের সৌন্দর্য সে কখনোই দেখে না। আমরা বাংলাদেশিরাও কি তেমনই নই? আমাদের দেশ, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ইতিহাস—এসব এতটাই সমৃদ্ধ, অথচ আমরা নিজেরাই যেন তা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারি না।

গত কয়েক সপ্তাহে আমি লিখেছি বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমি ও অর্গানিক কৃষি নিয়ে—দুইটি ক্ষেত্রই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ অর্থনীতির জন্য বিশাল সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। আমাদের সমুদ্রসীমা, উপকূলীয় অঞ্চল ও নদীগুলো বিশাল সম্পদ, যা আজও যথাযথভাবে ব্যবহৃত হয়নি। তেমনি আমাদের মাটি—বিশ্বের অন্যতম উর্বর ভূমি—যা অর্গানিক কৃষির মাধ্যমে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।

কিন্তু এই আর্থিক সম্ভাবনার বাইরেও, বাংলাদেশের আসল শক্তি লুকিয়ে আছে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, শহর থেকে শহরে ছড়িয়ে থাকা এক অনন্য রূপে। ঢাকার ব্যস্ততা, নান্দনিক স্থাপত্য আর ঐতিহাসিক স্থানগুলো যেমন আমাদের শহুরে সংস্কৃতির চিত্র তুলে ধরে, তেমনি চট্টগ্রামের পাহাড়, সমুদ্র আর নদীর মিলন আমাদের প্রকৃতির বিশালতাকে তুলে ধরে।

সিলেটের কথা বললে চোখে ভেসে ওঠে চা-বাগান, সবুজ পাহাড় আর পাথরভরা নদী। কক্সবাজার—বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত—যেখানে সূর্যাস্ত যেন প্রতিদিন নতুন করে প্রেমে ফেলে। বরিশাল—‘পানির ওপর ভেসে থাকা শহর’—যেখানে নদী আর খাল একে অপরকে জড়িয়ে রেখেছে ভালোবাসার মতো। খুলনার সুন্দরবন—বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন—যেখানে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ আর অসংখ্য প্রজাতির পাখি আমাদের জীববৈচিত্র্যের গর্ব।

রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা—প্রতিটি শহরেই রয়েছে আলাদা স্বাদ, সংস্কৃতি আর সৌন্দর্য। কোথাও মসজিদের মিনারে গড়ে ওঠা ইতিহাস, কোথাও নকশীকাঁথার মতো গ্রামের জীবন, আবার কোথাও পদ্মা-মেঘনার বুকে ভাসমান জেলেদের গল্প।

এই দেশ শুধু প্রকৃতির নয়, আত্মারও এক নিবাস। আমি প্রবাসে থাকি, কিন্তু প্রতিদিনই মনে হয় বাংলাদেশ আমার খুব কাছেই। আমার মতো লাখো প্রবাসী—যারা ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত—তারা নিজের ঘাম, শ্রম আর ভালোবাসা দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। তবে এখন সময় এসেছে ভিন্নভাবে চিন্তা করার।

আমরা কেবল টাকা পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে পারি না। টেকসই পরিবর্তনের জন্য দরকার এমন উদ্যোগ, যা মানুষকে স্বাবলম্বী করে। একটি সেলাই মেশিন, একটি ব্যবসার সুযোগ, একটি প্রশিক্ষণ—এসব সামান্য সহায়তা একটি পরিবার, এমনকি একটি প্রজন্মের ভবিষ্যৎ বদলে দিতে পারে।

আমাদের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য—সবই আমাদের পরিচয়ের গৌরব। কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহের চেতনা, লালন শাহ’র দর্শন, হাসন রাজার লোকজ সুর—এসব আমাদের আত্মার অংশ। এই গৌরবকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরার দায়িত্ব আমাদের সবার।

আজ যে প্রজাপতির ছবি আমি দেখেছি, তার পাখায় ছিল বাংলাদেশের পতাকা। তা যেন বলছে—তোমরা উড়তে পারো, তোমাদের সৌন্দর্য আছে, শুধু নিজেদের উপর বিশ্বাস রাখো।

আমরা হয়তো নিজের ডানা দেখতে পাই না, কিন্তু যখন একসাথে উড়ি, তখন পুরো বিশ্ব দেখতে পায়—এটা-ই তো বাংলাদেশ।

আসুন, নিজেদের জানি। নিজেদের ভালোবাসি। সম্ভাবনাকে বিশ্বাস করি। এবং একসাথে উড়ি—প্রজাপতির মতো।

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন