অহংকার পতনের মূল, আর ধৈর্য উত্থানের সিঁড়ি। বিনয়ী থাকা জরুরি
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
আমি যা পেয়েছি, তা আমার যোগ্যতার চেয়েও অধিক। তাই অহংকার করা আমার সাজে না। আপনি হয়তো আপনার যোগ্যতম স্থানে পৌঁছাতে পারেননি। কোনো প্রতিবন্ধকতা স্বপ্ন পূরণের অন্তরায় হয়েছিল। তবুও হা-হুতাশে জীবন বিষিয়ে তোলা উচিত নয়। অনেক কিছু পেয়েছি বলে যদি খানিক অহংকার করি, তবে আমার অর্জন বৃথা হয়ে যাবে। ক্ষণিকের এই জীবনে আপনি যদি মন খারাপ করে বসে থাকেন, তবে সমস্যার সমাধান হবে কি? বরং জীবনের জটিলতা বাড়বে।
স্রষ্টা যাকে যেখানে উপযুক্ত মনে করেছেন, তাকে সেখানে উপনীত করেছেন। কর্মের ভেতরেই কারও পতন অনিবার্য রেখেছেন, আবার সেই একই কর্মে কাউকে সম্মানিত হওয়ার সুযোগও দিয়েছেন। আমরা কেউই পরীক্ষার বাইরে নই। সময় নিরন্তর আবর্তিত হচ্ছে। নদীর যে কূল ভাঙছে, তার বিপরীতে গড়ছে।
অহংকার পতনের মূল, আর ধৈর্য উত্থানের সিঁড়ি। বিনয়ী থাকা জরুরি। বড় চাকরি মানেই জীবন বড় হয়ে গেল—এমন ভাবার সুযোগ নেই। গ্যারান্টিযুক্ত আয়ু কেউ পায়নি। কত রথী-মহারথী মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে, শারীরিক অসুস্থতায় ধুঁকছে। পোশাক দেখে সুখের পরিমাণ নির্ধারণ করা যায় না।
ভোগের তো সীমা-পরিসীমা নেই। যাদের চোখে ক্ষুধা, মনে যাদের বিস্তীর্ণ লোভ, কিংবা ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা যাদের অসীম— তাদের জীবনে সন্তুষ্ট হওয়ার সুযোগ সামান্যই। যারা মানসিকভাবে পরিতৃপ্ত নয়, তারা আসলে অকৃতজ্ঞ। আর অকৃতজ্ঞরা আজীবন রবের অসন্তুষ্টির তালিকায় থাকে।
রূপ-যৌবন নিয়ে, অর্থ-সম্পদ দিয়ে কিংবা ক্ষমতা-প্রতিপত্তি দেখিয়ে মানুষের ওপর জুলুম চাপিয়ে দেওয়া যায়; ধোঁকা দিয়ে, ঠকিয়ে কিংবা ঠেকিয়ে স্বার্থ হাসিল করা যায়। তবে আড়ালে মানুষ যা বলে, যদি সেই কথা সুস্থ বিবেক শুনতে পেত, তবে মানুষ লজ্জায় মৃত্যুর পথ খুঁজত। আজীবন একা পালিয়ে বেড়ানোর সুযোগ তালাশ করত।
অহংকার আর দম্ভে যারা মানুষকে মূল্যায়ন করে না, গরিব-অসহায়কে মানুষ বলে মনে করে না— তারা মনুষ্যত্ব অর্জনের দৌড়ে বহু পিছিয়ে। যিনি মহাপরিকল্পনাবিদ, তাঁর পরিকল্পনায় আছে সামগ্রিক কল্যাণ। তিনি তখনই কাউকে প্রাপ্তির উপযুক্ত করেন, যখন সে সেই মর্যাদা রক্ষা করতে জানে। তিনি কাউকে ঠকান— এই ধারণা তাঁর ইজ্জত ও জাতের পরিপন্থী।
জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির অঙ্ক যেভাবে আমরা দেখি, তা এতটা সরল নয়। সবকিছুর আড়ালে আছে এক সূক্ষ্ম নকশা।
যারা নিজের বড়ত্ব জাহির করে, খোদা তাদের অসম্মানিত করার দরজা খুলে দেন। তিনি দিয়েও পরীক্ষা করেন, আবার না দিয়েও কৃতজ্ঞতা মাপেন। মানুষ যা চায়, যদি সবই পেয়ে যেত— তবে সুখ ও দুঃখের রোমাঞ্চকর গল্পের জন্ম হতো না। মানুষ তখন হাসতে অথবা কাঁদতে ভুলে যেত। জীবন অর্থহীন মনে হতো।
ইতিহাসের পাতায় পাতায় অহংকারীদের পতনের কাহিনি রচিত হয়েছে। অথচ যারা বিনয়ী ছিল, মানুষের দরদ ধরেছিল, মানুষের পাশে ছিল— তারা অনাকাঙ্ক্ষিত পথেও বিস্ময়করভাবে সম্মানিত হয়েছে। তাতে অর্জিত হয়েছে মানসিক তৃপ্তি।
টাকা-পয়সা কিংবা অর্থবিত্ত সুন্দর ও মহৎ জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়। সম্পদের দ্বারা হয়তো জীবনে স্থূল সুখের সূচনা হয়, কিন্তু জীবনের আসল মূল্য উপলব্ধি করতে হয় সময়ের পরতে পরতে— সূক্ষ্ম সুখের সন্ধান করে। দুঃখ-সুখ সমভাবে গ্রহণ করার মনোভাব গড়তে হয়। তবেই আত্মিক বিকাশ নিশ্চিত হবে।
ভোগ তখনই উপভোগ্য, যখন পশ্চাতে থাকে এক বঞ্চনার ইতিহাস। যে মানুষ নিজে আঘাত পেয়েছে, সে যদি আবার অন্যকে আঘাত করে প্রতিশোধ নেয়, তবে বুঝতে হবে সে এখনো প্রকৃত শিক্ষা অর্জন করেনি। ক্ষমার মতো সুন্দর কিছু পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
কৃতজ্ঞ চিত্তে নত হওয়া, সর্বাবস্থায় সন্তুষ্ট থাকা— এর চেয়ে সুশোভিত কিছু আর হতে পারে না। অহংকার পরিত্যাগ করে, সকল মানুষের সঙ্গে কাতারবন্দি হয়ে বাঁচার মাঝেই মানবজীবনের আসল পরিতৃপ্তি।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন