ভালোবাসার ইউএনও: মঠবাড়িয়া যাকে কখনো ভুলবে না

gbn


রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক। 

আজ বোধহয় ইউএনও আব্দুল কাইয়ূম মহোদয়কে নিয়ে কিছু কথা মন খুলে বলা যায়। মঠবাড়িয়াবাসীর সঙ্গে তাঁর বাহ্যিক দায়িত্বপূর্ণ সম্পর্কের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। ফলে আজ তাঁকে নিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে কথা বললেও, তাতে স্বার্থসংশ্লিষ্টতার অপবাদ দেওয়ার সুযোগ নেই। একজন নাগরিক হিসেবে এই মানুষটি সম্পর্কে কিছু বলা দায়িত্ব বলেই মনে করছি— অন্তত কৃতজ্ঞতার ভাষা হয়ে হলেও, কিছু না কিছু বলতেই হয়। সত্যের প্রচার ও প্রকাশেও যদি কিছু পূণ্য মেলে- সেই আশায়।

 

পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার ইউএনও হিসেবে দীর্ঘদিন নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের পর, ২০২৫ সালের ১০ এপ্রিল তাঁকে পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় সমপদে বদলি করা হয়েছে। বদলি সরকারি চাকরির স্বাভাবিক অংশ। কিন্তু তাঁকে বিদায় জানানোটা মঠবাড়িয়াবাসীর পক্ষে মোটেও সহজ হবে না। এই মানুষটির জন্যে এক অদ্ভুত মায়া তৈরি হয়ে গেছে, যেটা আর দশজনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে হয় না।

 

যেখানে দেশে সরকারি সেবাপ্রদান নিয়ে ক্ষোভ-হতাশা সাধারণ চিত্র, সেখানে জনাব আব্দুল কাইয়ূম মহোদয় ছিলেন এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। তিনি ছিলেন একজন নিঃস্বার্থ, সৎ, নিরহংকারী ও সাদা মনের মানুষ— যিনি কর্মে, ব্যবহারে এবং চারিত্রিকে সত্যিকারের একজন ‘ভালো মানুষ’ হিসেবে সর্বসাধারণের কাছে স্বীকৃতি পেয়েছেন। সাধারণ ভিক্ষুক থেকে শুরু করে সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মানুষের জন্য ছিল তাঁর দরজা খোলা। মানুষ তাঁর কাছে এসে পেয়েছে সাড়া, বলেছে সমস্যা, আর পেয়েছে সমাধান। 

 

তাঁর সম্পর্কে কখনও কোনো দুর্নামের গল্প শোনা যায়নি। বরং মানুষ তাঁকে তুলনা করেছে একজন আদর্শবান, দরদী এবং দেশপ্রেমিক সহকর্মীর সঙ্গে। প্রায় তিন লাখ মানুষের মঠবাড়িয়াকে তিনি সন্তানের মতো আগলে রেখেছেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে, কর্মে এবং ব্যবস্থাপনায় জনসাধারণ সবসময় একজন অভিভাবকের ছায়া দেখেছে। 

 

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতির প্রতিটি স্তরে মঠবাড়িয়াকে তিনি ছুঁয়ে দিয়েছেন। নাগরিক সেবা যেন নাগরিকের দুয়ারে পৌঁছায়, সেই চেষ্টায় তাঁর আন্তরিকতা ছিল দেখার মতো। তিনি জনগণের সেবক হিসেবে যে গৌরবময় উদাহরণ স্থাপন করেছেন, তা সত্যিকার অর্থেই চিরস্মরণীয়। এই জীবনে যদি সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হয় 'মানুষের দোয়া'—তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, মঠবাড়িয়াবাসীর প্রার্থনা ও ভালোবাসা তিনি এককভাবে অর্জন করেছেন।

 

আব্দুল কাইয়ূম জানেন ভালোবাসা জয় করতে হয় —কথায়, কাজে এবং আচরণে। তিনি যেমন মঠবাড়িয়াকে ভালোবেসে গেছেন, তেমনি মঠবাড়িয়াও তাঁকে প্রাণভরে ভালোবেসেছে। তাঁর বিদায়ের খবরে শিক্ষার্থী-শিক্ষক, ব্যবসায়ী-নাগরিক, ইমাম-মুয়াজ্জিন— সবার চোখে অশ্রু দেখা দেবে। তিনি শুধু একজন ইউএনও ছিলেন না, ছিলেন একজন আপনজন, একজন আশ্রয়স্থল। যাকে অফিসে এবং মসজিদে- সর্বত্রই সময়মতো পাওয়া যেত।

 

নির্মোহভাবে দায়িত্ব পালন বলতে যা বোঝায়, তাঁর মধ্যেই আমরা তা দেখেছি। দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি—মঠবাড়িয়া থেকে অতি সামান্য কিছুও তিনি অবৈধভাবে গ্রহণ করেননি। দাফতরিক ব্যালেন্সনীতি ছাড়া কোননো ব্যক্তিগত অন্যায় তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। প্রশংসা ও সমালোচনা সমানভাবে সামলে নিয়ে তিনি নির্মোহ দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর সাদাসিধে জীবনযাপন, মিষ্টি ব্যবহার ও সকলের সঙ্গে সহজভাবে মিশে যাওয়ার যে শিক্ষাটা তিনি আমাদের শহর ও সমাজকে দিয়ে গেছেন, তা অনেকেই গ্রহণ করেছে ব্যক্তি জীবনের আদর্শ হিসেবে—হয়তো তা তিনি নিজেও জানেন না। কিছু প্রভাব থাকে—যা গোপনেই রয়ে যায় কিন্তু বহু হৃদয়ে ছাপ ফেলে।

 

এই লেখা বড় করার ইচ্ছে ছিল কিন্তু আবেগ আর চোখের পানির ভারে থেমে যেতে হচ্ছে। শব্দের ওজনের চাইতে অশ্রুর বোঝা ভারী ঠেকছে। বেশিরভাগ সময় চেয়ার মানুষকে সম্মানিত করে। তবে জনাব আব্দুল কাইয়ূম সেই বিরল ব্যতিক্রম—যিনি নিজে চেয়ারকে সম্মানিত করেছেন। এমন একজন সন্তান জন্ম দিয়েই তাঁর বাবা-মা পরম পূণ্যের অধিকারী হয়েছেন।

 

মঠবাড়িয়া পৌরসভার প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসক হিসেবে নাগরিক সেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে তাঁর নিষ্ঠা ও শ্রম আল্লাহ কবুল করুন।

 

রাষ্ট্র যদি বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় একজন করে আব্দুল কাইয়ূমকে দায়িত্ব দিতে পারতো, তবে ‘সোনার বাংলা’ গড়া খুব একটা কঠিন কাজ হতো না। তিনি যে দরদ আর ভালোবাসা দিয়ে মঠবাড়িয়াকে গড়ে তুলেছেন, তা তাঁর উত্তরসূরীদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে। কারণ সেই ভালোবাসায় যদি কোনো ঘাটতি হয়— তবে বারবার আমাদের মনে পড়বে একজন আব্দুল কাইয়ূমের কথা।

 

ভালো থাকুন প্রিয় ইউএনও স্যার। আপনি ছিলেন আমাদের আশার বাতিঘর। আপনি যেন দুঃখের ছায়াও না দেখেন। একদিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে আপনাকে দেখতে চাই—এই স্বপ্ন বুকে পুষে রাখি। ভালো মানুষের প্রতি রবের বিশেষ দৃষ্টি থাকে—এই বিশ্বাস আমাদের। সন্তান, পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে থাকুন—এই হৃদয় নিংড়ানো শুভকামনা।

 

 

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন