নিজাম এম রহমান || জিবি নিউজ ||
এই মুহূর্তে বাংলাদেশ এক গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। একের পর এক রাজনৈতিক দল তাদের ইশতেহার ঘোষণা করছে, নতুন নামগুলোও রাজনীতির মঞ্চে জায়গা করে নিচ্ছে। এটি শুধু আরেকটা নির্বাচন নয়—এটি একটি বিরল সুযোগ আমাদের দেশকে নতুনভাবে কল্পনা করার, নতুন করে গড়ার। নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের সময়সীমা প্রায় শেষ, কিন্তু আসল সময়সীমা আরও গভীরে—এটি একটি দৃষ্টিভঙ্গির সময়সীমা, সাহসী চিন্তার সময়সীমা, বাস্তব পরিবর্তনের সময়সীমা।
আমি চারপাশে তাকিয়ে এখনো এমন একটি রাজনৈতিক শক্তির অপেক্ষায় আছি যারা সত্যিকার অর্থে জনগণকে অগ্রাধিকার দেবে—শুধু স্লোগানে নয়, কাজেও। আমি এমন একটি দল দেখতে চাই, যারা সাহস করে এমন একটি ইশতেহার দেবে যেটি ন্যায্যতা, সহমর্মিতা ও দীর্ঘমেয়াদি টেকসই পরিকল্পনার উপর দাঁড়িয়ে থাকবে।
চলুন কল্পনা করি, সেই ভবিষ্যতের চিত্র কেমন হতে পারে।
⸻
সবার জন্য শিক্ষা ও চিকিৎসা—যাদের প্রয়োজন তাদের জন্য বিনামূল্যে
চলুন শুরু করি আমাদের ভবিষ্যৎ—আমাদের শিক্ষার্থীদের দিয়ে। বাংলাদেশে যেন এইচএসসি পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিক্ষা পাওয়া যায়—কোনও ফি নেই, কোনও লুকানো খরচ নেই, কোনও শিশু যেন কেবল টাকার অভাবে স্কুল থেকে বাদ না পড়ে। এর পাশাপাশি প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন পুষ্টিকর ও বিনামূল্যের স্কুল লাঞ্চ পায়—যেমনটা উন্নত দেশগুলোতে হয়। এইচএসসি পরবর্তী ফুল-টাইম শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, একটি সুস্থ শিক্ষার্থীই একটি সুস্থ জাতির ভিত্তি।
এবং এই সেবা শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য নয়। আমাদের দায়িত্ব হল যারা অসুস্থ, অক্ষম অথবা বয়সজনিত কারণে কাজ করতে পারছে না—তাদের জন্য সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা নিশ্চিত করা। একটি সভ্য রাষ্ট্র তার সবচেয়ে দুর্বল নাগরিকদের যত্ন নেয়। আর যারা নেয় না, তারা কখনোই এগিয়ে যেতে পারে না।
⸻
কর্মসংস্থান, শ্রমিক অধিকার এবং উদ্যোক্তাদের সম্মান
আমাদের চাকরির বাজারে সংস্কার দরকার। কর্মীরা যেন সুরক্ষা পায়, শোষণ নয়। গুণগত ও টেকসই কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা এখন সময়ের দাবি। যারা ব্যবসা করছেন, রাজস্ব দিচ্ছেন—তাদের যেন সম্মান দেওয়া হয়, সহায়তা করা হয়। তারা যেন হয়রানির শিকার না হন।
এর সঙ্গে গৃহকর্মীদের কথাও বলতে চাই। বাংলাদেশে কোনও শিশুকে আর গৃহকর্মী হিসেবে দেখতে চাই না। ছোট ছোট হাত যেন আর থালা ধোয় না, কাপড় চিপে না। গৃহকর্মীদের নিবন্ধন, প্রশিক্ষণ ও সুরক্ষা দিতে হবে। তাদের সম্মানজনক জীবনের পথ তৈরি করতে হবে।
⸻
কৃষকের মর্যাদা ও অর্গানিক বাংলাদেশের পথচলা
কৃষকরা আমাদের দেশের মেরুদণ্ড, অথচ তাদের ন্যায্য মূল্য মেলে না। তাদের উৎপাদনের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করতে হবে। সেইসঙ্গে কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। আজ যেখানে ফসল ফলত, সেখানে কংক্রিট উঠছে। এতে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ছে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হতে পারে অর্গানিক কৃষির নেতৃত্বে। অর্গানিক চাষ ও মাছ চাষে কঠোর আইন প্রণয়ন করা উচিত। সব পশু ও হাঁস-মুরগি যেন অর্গানিক উপায়ে পালন হয়—এটা নিশ্চিত করতে হবে। কোনও রাসায়নিক, ক্ষতিকর কীটনাশক বা অ্যান্টিবায়োটিক নয়। এতে আমরা শুধু স্বাস্থ্যবান হব না, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতাও করতে পারব।
আমাদের প্রতিবেশীদের চেয়ে আমাদের জমি কম—সেই কারণে আমাদের শক্তি হতে হবে গুণমান ও মূল্য সংযোজন। বিশ্ব যেন জানে—বাংলাদেশ মানে পরিচ্ছন্ন খাদ্য, সৎ চাষাবাদ, আর টেকসই ভবিষ্যৎ।
⸻
স্থানীয় সরকার সংস্কার ও জনগণের সেবা নিশ্চিত
সিটি কর্পোরেশন ও ইউনিয়ন অফিসগুলোতে সংস্কার দরকার। অনেক সময় অবকাঠামো নির্মাণের কাজ দেওয়া হয় রাজনৈতিক পরিচিতির ভিত্তিতে। কাজ শেষ হলে ঠিকাদার উধাও। রাস্তা তৈরি হয়, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের কোনও পরিকল্পনা থাকে না।
এই ধারা বদলাতে হবে।
প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন বা ইউনিয়ন পরিষদে স্থায়ী মেরামত টিম থাকতে হবে। যারা স্থানীয়ভাবে কাজ করবে, জনগণের কাছে থাকবে, কোনও রাজনৈতিক সুবিধাভোগী ঠিকাদার নয়। যেন যখনই রাস্তা ভাঙে বা নালার সমস্যা হয়, জনগণ সরাসরি অভিযোগ করে তাৎক্ষণিক সেবা পায়। এইভাবেই একটি সত্যিকারের জনবান্ধব প্রশাসন গড়ে ওঠে।
⸻
রাজনীতি নয়, আগে চাই ন্যায়বিচার
যদিও নির্বাচন এখনও ঘোষণা হয়নি, তবে আমরা সবাই জানি, সামনে নির্বাচন আসছে। তবে তার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়—ন্যায়বিচার। বিগত ১৬ বছর ধরে একটি সরকার দেশ শাসন করেছে—অনেকের মতে, প্রায় একনায়কতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। যদি নির্বাচন পরবর্তী সময়ে বিচার শুরু হয়, সেটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হবে।
এই কারণে আমার বিশ্বাস, যারা দেশের ক্ষতি করেছে, তাদের বিচারের প্রক্রিয়া এখনই শুরু হওয়া উচিত। যেন জনগণ দেখে—এই বিচার দলীয় নয়, বরং সঠিক সময়ে সঠিক ন্যায়বিচার।
আমরা সৌভাগ্যবান, এখন যারা বাংলাদেশ পরিচালনা করছেন, তারা দায়িত্ববান এবং দূরদর্শী। আমি আশাবাদী, তারা দেশের স্বার্থেই সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন।
কারণ যদি আমরা এই মুহূর্তে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি, তবে আমাদের হাতে সেই ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ আছে—যেটা আমরা সত্যিই প্রাপ্য।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন