শাসনহীনতার ছায়ায় শিক্ষাঙ্গন

gbn

যেসব সন্তানের ওপর বাবা-মা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন, সে সকল সন্তান বড়দের, শিক্ষকদের কিংবা গুণীদের কথা শুনবে? মোটেই শুনছে না।

রাজু আহমেদ। প্রাবন্ধিক।  

বাসে ঢাকা কলেজের ছাত্র আছে—এমন সন্দেহে হামলা এবং ভাঙচুর, পরীক্ষা ভালো হয়নি তাই পরীক্ষা শেষে কক্ষ তছনছ, ফলাফলে ফেল করায় শিক্ষা বোর্ড ঘেরাও দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের হেনস্তা, পূর্ব ঘোষণা দিয়ে এক কলেজের শিক্ষার্থীদের দ্বারা অন্য কলেজে লঙ্কাকাণ্ড ঘটানো—প্রতিনিয়ত এসবের স্বাক্ষী হচ্ছে দেশ।

 

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নেই। যারা উপস্থিত, তারাও জানে না গতকাল কী নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করতে গেলে শিক্ষকদের লজ্জা পেতে হয়। দেদারসে এই সার্কাস চলছে। শিক্ষকদের হেনস্তা, অযৌক্তিক দাবিদাওয়া নিয়ে হট্টগোল এবং রাস্তা অবরোধ—নিত্যনৈমিত্তিক রুটিন এখন। শিক্ষার্থীদের দিয়ে রাজ্যের সব কাজ করানো যায়, শুধু পড়াশোনা ব্যতীত। পড়তে বললেই সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে দেয়াল লিখন, হয়রানি শুরু হয়। চালানো হয় ব্যক্তি আক্রমণ। চাঁদাবাজি, মারামারি—সবকিছুতেই শিক্ষার্থীদের সরব উপস্থিতি আছে। শিক্ষার্থীদের একাংশ কিশোর গ্যাংয়ের সৈনিক!

 

বলা হয়ে থাকে, এই বাংলাদেশ ততদূর যাবে যতদূর শিক্ষার্থীরা নিয়ে যেতে পারবে। তরুণ প্রজন্মের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে কার? এরা আসলে কার কথা শোনে? বিড়ি-সিগারেট থেকে শুরু করে নেশার রাজ্যে কতিপয় শিক্ষার্থীর অবাধ বিচরণ। এমনকি বাবা-মায়ের নিয়ন্ত্রণেও নেই তাদের সন্তানরা। প্রশাসনের কাছে, পুলিশের হাতে গোপন আর্জি আসে—“দয়া করে আমাদের ছেলেকে দুই বছর জেল দিয়ে দিন। অত্যাচার আর সহ্য করতে পারছি না।” অনেক মা-বাবা না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সন্তানদের উৎপাত সহ্য করতে। বাইকের জন্য, দামি মোবাইলের দাবিতে, মোটকথা উঠতে-বসতে বাবা-মাকে জিম্মি করা হচ্ছে। ভালো ফলাফলের আশায় দেখানো লাগছে প্রলোভন।

 

কজনের শিশু সন্তান সন্ধ্যা হতেই ঘরে ফেরে? আর কতজনের সন্তান রাতের কখন ঘুমাতে যায়—তা বাবা-মা জানেনও না। কিছু বললেই বাঁধে বিপত্তি।

 

যেসব সন্তানের ওপর বাবা-মা নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন, সে সকল সন্তান বড়দের, শিক্ষকদের কিংবা গুণীদের কথা শুনবে? মোটেই শুনছে না। রোজ সারাদেশে যত দুর্ঘটনা ঘটছে, মারামারি-কাটাকাটি হচ্ছে, সেসবের অধিকাংশে শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্টতা আছে। নেশাগ্রস্ত প্রজন্মের যার সঙ্গে বন্ধুত্ব, আবার তাদের মধ্যেই তুমুল মারামারি দেখি। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানে দ্বন্দ্ব। পরস্পর পরস্পরকে সম্বোধনে যে সকল শব্দ ও ভাষা ব্যবহার করে, তা সভ্য সমাজে ব্যবহার অনুপযুক্ত ও আপত্তিকর।

 

শিক্ষার্থীদের এমন উচ্ছনে যাওয়ার স্বাক্ষী হতে নব্বই দশকের মানুষ হিসেবে খুব বিব্রত বোধ করি। তখন যেন মনে হয়, ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’ চিরসত্য। স্কুল ইউনিফর্মে শিক্ষার্থীদের একাংশ প্রকাশ্যে সিগারেট ফুঁকছে। বাসা থেকে কলেজের কথা বলে বের হয়ে বান্ধবী নিয়ে পার্কে আড্ডা দিচ্ছে। বড়দের শুনিয়ে শুনিয়ে স্ল্যাং ব্যবহার করছে। কেউ তাদের কোনো ভালো পরামর্শ দিলে তাকেই শত্রু ভাবছে। কেননা যারা সত্য কথা বলতে বলে, পড়াশোনা করতে তাগিদ দেয় কিংবা জীবনে বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতে বলে—তারা তো উচ্ছন্নদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথা বলছে।

 

নয়তো কেউ পরীক্ষায় ফেল করলে সে আবার পাশের দাবিতে আন্দোলন করতে পারে? লজ্জাও আজকাল মানুষ দেখে লজ্জা পায়, বোধহয়। পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার দাবিতে যারা ব্যানার নিয়ে মিছিলে নামে—ওরা সেই প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব করে যারা পরীক্ষার সময় মহাকাল পরিমাণ পিছিয়ে দিলেও ভালো ফলাফল করবে না।

 

শিক্ষার্থীরা পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে এমন নৃশংসভাবে হামলা-মারামারি করছে, যা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকেও হার মানায়।

 

বর্তমানে এই বিপথে যাওয়া এবং অতীতে সুপথে থাকা—এর অন্তরালের হেতু কী? তখন শিক্ষকদের হাতে নীতির লাঠি ছিল। কড়া শাসন ছিল। শুধু আদরে যে সন্তান বেড়ে ওঠে, সে শিক্ষক তো পরের কথা, আপন বাবা-মায়ের কথাও শুনবে না। মানুষ হতে হলে শাসন ও আদরের সংমিশ্রণে তাকে গড়ে তুলতে হবে।

 

ফিনল্যান্ডে জন্ম নেওয়া একটি শিশুর সাথে বাংলাদেশের শিশুর মনস্তত্ত্বের মিল নেই। বনানীতে বেড়ে ওঠা শিশুর সাথে বলেশ্বরের চরে বেড়ে ওঠা একটি শিশুকে তুলনা করা যাবে না। যে নৈতিক বোধকে ভিত্তি করে স্কুল-কলেজ থেকে বেত উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, তা বোধহয় পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। শাসনবিহীন শিক্ষা ব্যবস্থার পরিণতি তো চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে।

 

রাষ্ট্র পরিচালনা করতে যতজন যোগ্য জনবল দরকার, যদি সরকারি কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা না-ও থাকে, তবুও অভিভাবকদের চেষ্টায় তা বের হয়ে আসবে। কিন্তু সাধারণ নাগরিক, জনগণ যদি সভ্য না হয়, শিক্ষিত ও মার্জিত না হয় তবে দেশের ভাগ্য বদলাবে না।

 

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি এবং আশকারাও শিক্ষার্থীদের বিপথে নিচ্ছে। তাছাড়া কতিপয় আদর্শ ও নীতিহীন শিক্ষকের হীন চরিত্র চরিতার্থ করার জন্য শিক্ষার্থীদের অপব্যবহারের ফলেও জাতি আদর্শ বিচ্যুতির শিক্ষা পাচ্ছে। ক্লাসের শিক্ষার্থীদের চেয়ে প্রাইভেট শিক্ষার্থীদের আলাদা কেয়ারও সুশিক্ষা বিমুখতার বড় কারণ।

 

শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরমত সহিষ্ণুতার ঘাটতি এবং কেবল ‘আমিই সঠিক’—এই বোধ একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সমাজ ও রাষ্ট্রের অপসিস্টেমের বলি হয়েছে শিক্ষার্থীরা। কাজেই সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের দ্বারা শিক্ষকদের যে অপমান ও হেনস্তার চিত্র সারাদেশে দেখেছি, তা বহুলাংশে কতিপয় শিক্ষকের সমন্বিত কর্মের ফল।

 

পাশের হার বৃদ্ধি করাতে হবে বলে না লিখে কিংবা অপ্রাসঙ্গিক লিখে পাশ করে যাওয়ার সংস্কৃতি, প্রতিষ্ঠানের সুনাম অক্ষুন্ন রাখার জন্য পরীক্ষার হলে নকল ও অনৈতিক সুবিধার বিস্তার, এবং অমুকের ছেলে বলে তাকে আলাদা চোখে মূল্যায়ন করা—এসব এই সমাজে পচনের সূচনা করেছে।

 

তারুণ্য এবং বেয়াদবি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। তারুণ্য তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে, জীবন দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠা করবে। বিগত পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে আমরা বহুবার তারুণ্যের জয়গান ও জোয়ারের কারণে অপশাসন, দুঃশাসন ও স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেয়েছি। সর্বশেষ জুলাই অভ্যুত্থানে তারুণ্যের জয়যাত্রা দেখেছি এবং সেটার সুফল ভোগ করছে গোটা জাতি।

 

কিন্তু পরবর্তীতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘কী হনুরে’র যে দম্ভ দেখা দিয়েছে, তাতে সমাজে ধারাবাহিক বেয়াদবির ক্ষতচিহ্ন এঁকেছে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে নিজেদের মধ্যে মারামারি, পথচারীদের জিম্মি করে অহেতুক পায়চারি—এসব কোনোভাবেই কাম্য নয়।

 

৫ আগস্ট পরবর্তী সরকারবিহীন সময়ে শিক্ষার্থীরা যেভাবে ট্রাফিকিং করেছে, মন্দির পাহারা দিয়েছে, বাড়ি-ঘর রক্ষা করেছে, বন্যাকবলিত মানুষকে উদ্ধার ও সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে—তা জাতির জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। আমরা তো তেমন তারুণ্যই প্রত্যাশা করি, যাদের প্রয়োজনের সময়ে, বিপদের সময়ে মানুষের পাশে পাব এবং বাকি সময়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে।

 

একজন শিক্ষার্থীর কাছে লেখাপড়ার বিকল্প আর কিছুই নাই, থাকার কথা নয়, থাকা উচিতও নয়। অথচ শ্রেণীকক্ষে যে চিত্র, পরীক্ষার খাতায় যে হাল দেখছি, তা জাতির জন্য চরম এলার্মিং। আমাদের ভবিষ্যৎবোধ উজ্জ্বল নয়। স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার বিশাল তফাৎ তৈরি করছে শিক্ষার্থীরা। তবে নিরাশার মধ্যেও আশার কথা—পড়াশোনায় আমাদের মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে।

 

শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে সরকারের বোধহয় কঠোর হওয়া দরকার। সন্তানদের ব্যাপারে অভিভাবকদের খোঁজখবর রাখা উচিত। ‘পাশ করিয়ে দাও’—এমন যে সকল দাবিদাওয়া নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামছে, কলেজ কলেজ পরিচয়ের দম্ভোক্তিতে যেভাবে মারামারি করছে কিংবা পরীক্ষা ভালো হয়নি তাই যেভাবে হলে ভাঙচুর চালাচ্ছে—তা কোনোভাবেই আকাঙ্ক্ষিত নয়।

 

অভিভাবক, শিক্ষক এবং সরকারের সমন্বিত উদ্যোগে শিক্ষার্থীদেরকে প্রতিষ্ঠানে ফেরাতে হবে। শিক্ষকদের কাছে শাসনের ক্ষমতা দিতে হবে। কোনো শিক্ষক ব্যক্তি আক্রমণ ও আক্রোশে শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন না। শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মঙ্গল প্রত্যাশী।

 

আজ যারা বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যারা দেশের হর্তা-কর্তা—শিক্ষাজীবন নিয়ে তাদের স্মৃতিচারণ করতে দিলে সবার শুরুতে শ্রেণীকক্ষের কড়া শিক্ষকের নাম উচ্চারণ করবেন। অনেকেই বলবেন—সেদিন যদি অমুক স্যার শাসন না করতেন তবে মানুষ হতাম না।

 

যুদ্ধের জন্য ভয়ডরহীন যোদ্ধা তৈরি করা প্রয়োজন। দক্ষ যোদ্ধা তখনই তৈরি হবে, যখন সে সৈনিক ট্রেনিং পিরিয়ডে এবং কর্মক্ষেত্রে নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করার সুযোগ পাবে। শিক্ষাজীবন একজন ছাত্রের জন্য সারাজীবনের শিক্ষাকাল। শাসন বিলোপ করে আমরা সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে অসংখ্য অমানুষের দেখা পাচ্ছি।

 

জাত হিসেবে নাকি উপজাত হিসেবে বেয়াদবির উদ্ভব হচ্ছে—তা বিশ্লেষণ করা দরকার। সব দায়িত্ব ও দায়ভার সরকারকে দিলে হবে না। প্রত্যেকেই যার যার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল। শিক্ষার্থীদের দ্বারা যা-কিছু সংগঠিত হতে দেখছি, তাতে আজকাল বড্ড শঙ্কিত হই। পরবর্তী প্রজন্ম কোনদিকে যাবে? বড়দের সম্মান না থাকা, ছোটদের শ্রদ্ধা না করা—এসব সমাজকে ভালো বার্তা দেয় না।

 

সকল সমাজে কিছু কিছু মন্দ থাকে। তবে মন্দ যখন ভালোকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ পায়, তখন ভালোত্ব মন্দত্বের দ্বারা সংক্রমিত হয়। শুধু খারাপকে শৃঙ্খলায়িত রাখার জন্য এবং ভালোকে রক্ষার জন্য শাসন এবং আদর—দুটোই প্রবলভাবে দরকার। নয়তো সামনে আরও নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।

 

 

gbn

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন