অসৎ পিয়নেরও বাড়ি-গাড়ি হয়
রাজু আহমেদ, প্রাবন্ধিক।
যারা এন্ট্রি লেভেলে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ স্কেল/গ্রেডে সরকারি চাকুরিতে যোগদান করে, তাদের সাকুল্যে বেতন ৩৫ হাজারের আশেপাশে। রাজধানী, বিভাগ, জেলা কিংবা উপজেলায় পদায়ন ভেদে বাড়িভাড়ার তারতম্যে অঙ্কের কিছুটা কমবেশি হতে পারে। প্রথম শ্রেণির পিছনেও আরও দুটো শ্রেণি আছে—দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি। প্রত্যেক শ্রেণির আবার উচ্চ ও নিম্ন ধাপ আছে। সরকার প্রদেয় সর্বনিম্ন বেতন ১৪ হাজারের কমবেশি।
চাকুরিতে সবচেয়ে কম সংখ্যক জনবল প্রথম শ্রেণির। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদাতেই জনবলের বড় সংখ্যা নিয়োজিত। বেতন, সঞ্চয় এবং ব্যয়ের হিসাবনিকাশ করে কখনো প্রশ্ন জাগে না যে, মানুষগুলোর সংসার কেমন চলছে? তারা টিকে আছে কেমনে? সরকারি চাকুরির যোগ্য হতে কত বছর বিনিয়োগ করতে হয়েছে এবং পরিবারকে কত টাকা ব্যয় করতে হয়েছে? টাকার হিসাব বাদ দিলাম। পড়াশোনার সময়কাল একটু হিসেব করে দেখি—মাস্টার্সে ১ বছর, অনার্সে ৪ বছর, উচ্চমাধ্যমিকে ২ বছর, মাধ্যমিকে ৫ বছর এবং প্রাথমিকে ৫ বছর। সর্বমোট ১৭ বছর বই খাতা হাতে ছুটতে হয়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে, সকল সরকারি চাকুরিতে কি মাস্টার্স ম্যান্ডেটরি? না। তবে দেশে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেকারের সংখ্যা এত অধিক যে আয়া, বুয়া, ঝাড়ুদার, দফাদার চেয়ে বিজ্ঞাপন দিলেও মাস্টার্স ডিগ্রির আবেদনে সয়লাব হয়ে যায়। এইট পাশদের কোথাও জায়গা হয় না! সরকারি চাকুরিজীবীরা এমন অল্প বেতনে চলছেন কেমনে? যাদের আয়ের উৎস শুধু বেতন এবং ব্যয়ের খাত বহু, তাদের তো আসলে দুর্দিন চলছে। তারা বেতন নিলেও তাদেরকে আবার সেবক উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ভাত খেতে না পারলেও, সংসার না চললেও কখনো সেবা প্রদান বিঘ্নিত করা যাবে না মর্মে নির্দেশনা ও অঙ্গীকার থাকে।
সরকারি চাকুরিজীবীদেরও আবার শ্রেণিবিভাগ আছে—অসৎ এবং সৎ! অসৎদের বেতন না হলেও চলে। যারা বিবেক বিক্রি করেছে, হালাল-হারামের পার্থক্য তুলে নিয়েছে, তাদের ব্যাপার ভিন্ন! যাদের উপরি কামাই আছে, তারা সমাজে কামাল জীবন যাপন করে। অসৎ পিয়নেরও বাড়ি-গাড়ি হয়। নীতিভ্রষ্ট বসেরও বিদেশে আলিশান জীবনযাপন হয়। ঘুষখোরদের সমাজে প্রভাব-প্রতিপত্তি তড়তড় করে বাড়ে। তারা অর্থবিত্ত দান করে নাম কাম কামায়। মোটকথা, তাদের এলাহি কারবার। মাঝে মাঝে তাদের দু-চারজন ভ্রষ্টাচারের অভিযোগে পাকড়াও হন। রাষ্ট্রের আমজনতা তাদের নিয়ে তর্কবিতর্ক সভা করে। দিন যায়! অসহায়ের ভাগ্য বদল ঘটে না।
যত সমস্যা তা তো সৎদের। পরিবারের চাহিদা মেটাতে পারে না। আত্মীয়স্বজনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে পারে না। সন্তানদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না। কেউ যাতে নিমন্ত্রণ না করে—স্রষ্টার কাছে সেই প্রার্থনা জানায়। যারা কাঁচাবাজার করে রাত্রে, মাছ-মুরগি কেনে দরদাম করে। ডিম-ডাল খেয়ে দিন পার করতে পারলে বাঁচে। যাদের দুই পয়সা খরচ করতে চারবার ভাবতে হয়, যাদের মাসের শেষে চালিয়ে নিতে টানাটানি লাগে—তাদের পাশে রাষ্ট্র দাঁড়ায়? সৎদের নিয়ে রাষ্ট্র ভাবে?
বেতন কম বললেই একদল বলে, তোমরা তো জেনেশুনেই বিষ করেছো পান। ২০১৫ সালের বেতন কাঠামো দিয়ে এই সময়টায় চলে না। ১০ বছরের ব্যবধানে দুনিয়ায় অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। তখনকার সময়ে দ্রব্যমূল্যের বাজারদর, জীবনযাত্রার ব্যয় এই সময়ের সাথে খাপ খায় না—কে কারে বোঝাবে? দুর্নীতির অন্যতম কারণ কম বেতন প্রদান করা। যতটুকু স্বাভাবিক চাহিদা, ততটুকু তো দিতেই হবে। আবার সম্পূর্ণ দিলেও একটি অংশের লোভ থাকবে, ঘুষ খাবে। তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির মুখোমুখি করতে হবে। কিন্তু যাদের চলছে না, যারা আধমরা হয়ে পড়ে আছে কিংবা বিষণ্নতার বিপন্নতায় যাদের দিন কাটছে, তাদের দিকে দেখুন। অল্প হলেও একটু একটু ভাবুন। এখন বোধহয় নতুন পে-স্কেল গঠন করা যৌক্তিক।
যারা বেতনে সংসার চালিয়ে সৎ থাকতে চায়, তাদের পাশে রাষ্ট্রের থাকা উচিত। রাষ্ট্রকে তো তখনই ভালো সেবা দেওয়া যাবে, যখন সংসারের অশান্তি মিটবে, সন্তানের সুবিধা নিশ্চিত হবে। এজন্য বেতন বাড়ানো জরুরি। ন্যায্যতাভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি পরিশোধ করা আবশ্যক। সরকারি চাকুরিজীবীদের বেতন যেহেতু স্বদেশী মুদ্রায় পরিশোধিত হয়, সেহেতু বেতন বেশি দিলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। বরং সে অর্থ বাজারে বিনিময় হয়ে অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি করবে এবং মুনাফার জন্ম দেবে। রাষ্ট্রের চেহারাও বদলাবে এবং কাজ আকর্ষণীয় হবে।
স্বাভাবিক জীবন ও জীবিকার জন্য যতটুকু দরকার, ততটুকু প্রদানের লক্ষ্য নির্ধারণ নিয়ে কর্তৃপক্ষ ভাবুক। চলমান বেতন কাঠামোয় জীবন আসলে চলছে না। বারবার থেমে যাচ্ছে, ধাক্কা খাচ্ছে। বেতনের সাথে তুলনা করে সরকারি চাকরি এখন লজ্জার কারণ হচ্ছে। যারা সৎভাবে বাঁচতে চায়, তাদেরকে সততায় বাঁচার ব্যবস্থা করে দিন। যারা স্বভাব দোষেই দুর্নীতি করে, তাদেরকে রুখে দিন। সর্বোচ্চ শাস্তি দিন। শুধু দুর্নীতি রোধ করার মাধ্যমে প্রচলিত বেতন কাঠামোর দ্বিগুণ বেতন পরিশোধ করা সম্ভব। দুর্নীতির অর্থ সঠিক চ্যানেলে প্রবেশ করাতে পারলে দেশের সামগ্রিক চিত্র বদলে যাবে। কাম্য বেতন নিশ্চিত করার ব্যবস্থায় উদ্যোগ নিন। তবেই রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির গতি ত্বরান্বিত হবে। ভুখা পেটে, অভাব পুষে কোনো সেক্টরে কাঙ্ক্ষিত সেবা প্রদান করা যায় না।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন