হুসনা খান হাসি ||
বিবাহবিচ্ছেদ (ডিভোর্স) আমাদের সমাজে একটি সংবেদনশীল ইস্যু, যা এখন বিশ্বব্যাপী ক্রমশ একটি সাধারণ সামাজিক বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এটি কেবল ব্যক্তিগত কোনো সিদ্ধান্ত বা দুটি মানুষের সম্পর্কের ইতি টানার বিষয় নয়; এর সঙ্গে পারিবারিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানা ধরনের জটিলতা গভীরভাবে জড়িত। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় পশ্চিমা দেশগুলোতে ডিভোর্সের হার দীর্ঘদিন ধরেই বেশি, তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেও বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে আজও বিবাহবিচ্ছেদকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়, বিশেষ করে নারীদের জন্য, যেখানে এটি এক ধরনের সামাজিক কলঙ্ক হিসেবে বিবেচিত হয়। অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর না হওয়ায় অনেক নারী বিবাহবিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পান। তবে প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো সমাজের সমালোচনা ও নেতিবাচক মানসিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। যদিও এসব প্রতিবন্ধকতা সহজ নয়, তবুও আত্মবিশ্বাস অর্জন এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতনভাবে এগিয়ে চললে, সমাজের চাপকে পেছনে ফেলে নতুন জীবন শুরু করা সম্ভব।
বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান কারণ
বিশ্বব্যাপী বিবাহবিচ্ছেদের পেছনে কিছু সাধারণ কারণ লক্ষ্য করা যায়। দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ
হতে পারে:
পারিবারিক সহিংসতা
অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে দাম্পত্য কলহ
বিশ্বাসঘাতকতা বা পরকীয়া
পারিবারিক চাপ
শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ
পারস্পরিক বোঝাপড়ার অভাব
ক্যারিয়ার বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিয়ে দ্বন্দ্ব
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিচার
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক সমাজে বিবাহবিচ্ছেদকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়। বিশেষ করে নারীরা এই প্রক্রিয়ায় বেশি সমালোচনার সম্মুখীন হন। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এমনকি বন্ধুরাও অনেক সময় বিচ্ছেদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে কাউকে দোষারোপ করে। অনেকেই মনে করেন যে একজন নারী বা পুরুষের বিবাহবিচ্ছেদ মানে তার ব্যর্থতা।
এছাড়াও, বিবাহবিচ্ছেদের পর সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। একজন বিবাহবিচ্ছেদ করা নারী যদি পুনরায় বিয়ে করতে চান, তবে সমাজের নানা বাধা পেরোতে হয়। পুরুষদের ক্ষেত্রেও কম-বেশি একই সমস্যা দেখা যায়, যদিও তারা তুলনামূলকভাবে কম সমালোচনার সম্মুখীন হন।
মানসিক ও ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ
বিবাহবিচ্ছেদের ফলে মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়া স্বাভাবিক। এটি এক ধরনের শোকের মতো, কারণ একটি সম্পর্কের সমাপ্তি অনেক আবেগ ও প্রত্যাশারও সমাপ্তি ঘটায়। একাকীত্ব, হতাশা, অনিশ্চয়তা এবং আত্মবিশ্বাসের অভাব, এসব অনুভূতি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। বিশেষ করে যদি সন্তান থাকে, তবে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ আরও বেশি দেখা যায়।
তবে মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য নিজেকে সময় দেওয়া জরুরি। নতুন জীবন শুরু করার জন্য ইতিবাচক চিন্তা, পরিবার ও ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সহায়তা, এবং পেশাগত উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
নতুন জীবনকে গ্রহণ করা
বিবাহবিচ্ছেদের পর নতুন জীবন শুরু করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এটি আসলে একটি সুযোগ, নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার, আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করার, এবং সুখের নতুন সংজ্ঞা খোঁজার:
১. আত্মপরিচয় খুঁজে পাওয়া: অনেক সময় বিবাহিত জীবনে মানুষ নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলে। বিচ্ছেদের পর সেই হারানো আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধার করা দরকার। নিজের পছন্দ-অপছন্দ, স্বপ্ন, এবং লক্ষ্য নতুনভাবে নির্ধারণ করা যেতে পারে।
২. পেশাগত উন্নতি: ক্যারিয়ার গড়ার দিকে মনোযোগ দিলে একদিকে যেমন আত্মনির্ভরশীল হওয়া যায়, অন্যদিকে মানসিক স্থিতিশীলতাও ফিরে আসে।
৩. সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি: নতুন বন্ধু তৈরি করা, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, এবং ইতিবাচক সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া জীবনকে সহজ করে তুলতে পারে।
৪. মানসিক সহায়তা গ্রহণ: কাউন্সেলিং বা থেরাপির মাধ্যমে মানসিক অবস্থা উন্নত করা সম্ভব। নিজেকে একা না রেখে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
নতুন জীবন শুরু করার উপায়
বিবাহবিচ্ছেদের পর নতুন জীবন শুরু করা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এটি এক ধরনের সুযোগ—নিজেকে নতুনভাবে গড়ে তোলার, আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধার করার, এবং সুখের নতুন সংজ্ঞা খোঁজার:
১. মানসিক শক্তি অর্জন:।বিবাহবিচ্ছেদের পর প্রথম ধাপ হলো মানসিকভাবে শক্ত হওয়া। থেরাপি বা কাউন্সেলিং গ্রহণ করলে হতাশা কাটিয়ে ওঠা সহজ হয়।
২. অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা: একজন স্বাবলম্বী ব্যক্তি সমাজের নেতিবাচক মন্তব্যকে সহজেই উপেক্ষা করতে পারে। গবেষণা বলছে, যারা বিচ্ছেদের পর স্বনির্ভর হন, তাদের ৮০% মানসিকভাবে আরও সুখী জীবনযাপন করেন।
৩. সামাজিক যোগাযোগ বৃদ্ধি: নতুন বন্ধু তৈরি করা, পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, এবং ইতিবাচক সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হওয়া জীবনকে সহজ করে তুলতে পারে।
৪. নতুন সম্পর্কের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি: অনেকেই বিবাহবিচ্ছেদের পর আর কোনো সম্পর্কে যেতে চান না। কিন্তু এটি জীবনের শেষ নয়। নতুন সম্পর্কের জন্য মনকে উন্মুক্ত রাখা উচিত।
শেষ কথায়, বিবাহবিচ্ছেদ জীবনের শেষ নয়, বরং এটি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা। সমাজের নেতিবাচক বিচার এবং মানসিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও একজন ব্যক্তি সফলভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারে। আত্মবিশ্বাস, মানসিক শক্তি, এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে নতুন জীবনে সুখ এবং শান্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। পরিসংখ্যান ও বাস্তব অভিজ্ঞতা দেখায় যে, যারা বিচ্ছেদের পর নিজেদের নতুনভাবে গড়ে তুলতে পারেন, তারা আগের তুলনায় আরও সুখী এবং আত্মবিশ্বাসী হন।
তাই বিবাহবিচ্ছেদকে শুধুমাত্র একটি ব্যর্থতা হিসেবে না দেখে, বরং এটি থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করাই শ্রেয়। সমাজকে বোঝাতে হবে যে, বিবাহবিচ্ছেদ ব্যর্থতা নয়, বরং এটি নতুনভাবে বাঁচার সুযোগ। আত্মবিশ্বাস, মানসিক শক্তি এবং ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে নতুন জীবনে সুখ এবং শান্তি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন