বুলবুল আহমদ, নবীগঞ্জ হবিগঞ্জ থেকেঃ- বিআরটিসি বাস চালু হওয়ার পর থেকেই শ্রমিকদের মধ্যে নানা আতংক দেখা দিয়েছে। সিলেটে দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছেন পরিবহন শ্রমিকরা। কথায় কথায় ধর্মঘট, যাতীদের সাথে দুর্ব্যবহার তাদের কাছে এসব ঘটনা নিত্যদিনের বিষয়। পাথর শ্রমিকদের সাথে পরিবহন শ্রমিকদের নূন্যতম কোন সম্পর্ক না থাকলেও তারা পাথর ইস্যুতেও ধর্মঘট দিতে দ্বিধাবোধ করেনা। সিলেটে পরিবহন শ্রমিকদের চলা ধর্মঘটের মধ্যেই গত মঙ্গলবার সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেনের উপস্থিততে সিলেট- শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জ রোডে বিআরটিসির বাস সার্ভিস উদ্বোধন করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। কিন্তু উদ্বোধনের ৫ দিনের মাথায় পরিবহন মালিকদের ইন্ধনে বিআরটিসির সিলেট ডিপোর অপারেশন ম্যানেজার জুলফিকার আলীকে মারধর এবং চালক ও হেলপারদের মারধর করে বিআরটিসির বাস বন্ধ করে দিয়েছে পরিবহন শ্রমিকরা। গত রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে অর্ধ শতাধিক শ্রমিক এসে বিআরটিসি কাউন্টারে তালা লাগিয়ে কর্মকর্তাদের সরকারি গাড়ি ভাঙ্গচুর করা হয়। তারা একটি গাড়িতে ভাঙ্গচুর চালিয়ে চালক ও হেলপারকে মারধর করে গাড়ি বন্ধ করে দেয়। এ ব্যাপারে তারা অভিযোগ করে বলেন, কাউন্টার ভাঙ্গচুর ও আমাদের উপর হামলা করে কাউন্টারে থাকা নগদ প্রায় সাড়ে ১২ হাজার টাকা ও একটি ল্যাপটপ ছিনিয়ে নেয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার সকাল ৯টায় মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল থেকে একটি বাস ছেড়ে আসার কথা থাকলেও শ্রমিকদের হুমকির মুখে বন্ধ রাখা হয়। এরপর হবিগঞ্জ থেকে আরেকটি বাস ছাড়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকরা চালক-হেলপারকে মারধর ও গাড়ির পেছনের গ্লাস ভাঙ্গচুর করা হয়। পরে যাত্রী ছাড়াই দুই বাস ফেরত আসতে হয়।
এ ব্যাপারে বিআরটিসি বাস সার্ভিস সিলেট ডিপো ব্যবস্থাপক জুলফিকার আলী বলেন, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ থেকে দু’টি বাস চলতে গেলে শ্রমিকরা আমাদের গাড়ী পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। এরপরও খালি বাসগুলো নিয়ে আসার পথে চালক ও হেলপারকে মারধর করে গাড়ির পেছনের গ্লাস ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় আমরা আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া চেষ্টায় আছি। তিনি আরো বলেন, যেখানে সেতুমন্ত্রী ওই দু’টি সড়কে বিআরটিসি বাস সার্ভিসের উদ্বোধন করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীরও প্রচেষ্টা ছিল ঐ বাস সার্ভিস চালুতে করতে। সারা বাংলাদেশে ২২টি ডিপোতে ৫৭০টি বাসের মধ্যে সিলেট ডিপোতে সর্বনিম্ন ৩০টি নতুন বাস নামানোর কথা ছিল। সেখানে এ দু’টি সড়কে পর্যায়ক্রমে ১২টি বাস নামানোর কথা। কিন্তু ২টি বাস চালু করেই মালিক-শ্রমিকদের তোপের মুখে বন্ধ করতে হচ্ছে। অথচ মন্ত্রী মহোদয় বাস সার্ভিসের উদ্বোধন করেছেন।
পরিবহন শ্রমিকদের দাবি, এই দুই রুটেই পর্যাপ্ত বাস রয়েছে। বিআরটিসি ইচ্ছে করলেই যে কোনো সড়কে বাস সার্ভিস শুরু করতে পারে না। এটা তাদের আইনের পরিপন্থী। এছাড়া বাস চালুর ব্যাপারে এই দুই রুটের মালিক ও শ্রমিকদের সাথে কোনো আলোচনাও করেনি বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ। তাই এসব রুটে বিআরটিসির বাস চলতে দেবেন না তারা।
আর বিআরটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, এই দুই রুটে এতোদিন যাত্রীদেরকে জিম্মি মাধ্যমে ব্যবসা চালিয়ে আসছিলো পরিবহন মালিকরা। বিআরটিসি বাস চালু হওয়ায় তাদের ব্যবসা কমে যেতে পারে এই ভয়ে বাস চালুতে বাধা দিচ্ছে।
বিআরটিসি কাউন্টারের ম্যানেজার অভিযোগ করে বলেন, সকালে ৯টায় শেরপুর মৌলভীবাজারগামী একটি বাস শেরপুরে অবরোধ করে পরিবহন শ্রমিকরা। এরপর সকাল সাড়ে ৯টায় হুমায়ুন রশীদ চত্বরে বিআরটিসি কাউন্টারে পরিবহন শ্রমিকরা এসে অতর্কিতে হামলা চালায়। এসময় তারা কাউন্টারেও লুটপাট করে ডিপো ইনচার্জ জুলফিকার আলীকে লাঞ্ছিত করে। ভেঙ্গে ফেলে তার সরকারি গাড়ির গ্লাস। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।
এদিকে, সিলেট বিভাগীয় বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জিয়াউল কবীর পলাশ বলেন, আমরা দেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরিবহন সেবা দিয়ে আসছি। কিন্তু বিআরটিসি বাস চালুর আগে কর্তৃপক্ষ আমাদের সঙ্গে বসেনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন কি না, তা আমাদের জানা নেই। আমরা মনে করি, এটা তারা চালাকি করছে। তবে, গাড়ি ভাঙ্গচুরের কথা অস্বীকার করেন তিনি।
সিলেট বাস, মিনিবাস, কোচ পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাচন কমিশনার ও কার্যকরী ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মোঃ গোলাম হাফিজ লোহিত বলেন, সিলেট থেকে আন্তঃজেলা বিআরটিসি বাস চলাচলে শ্রমিকরা বাধা দিচ্ছে না। মূলত বিভাগীয় সড়ক ৯০ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এরমধ্যে সিএনজি অটোরিক্সা, লোকাল বাস সার্ভিসের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। তার উপর আবার বিআরটিসি বাস চলবে, তাতে বাস মালিক শ্রমিকরা চরম ক্ষতির সম্মুখীন। তাছাড়া নানাভাবে সৃষ্ট জটিলতার মধ্যেও আলোচনা না করেই বিআরটিসি বাস নামানোর নেপথ্যেও ঠিকাদাররা জড়িত আছেন বলে মনে করেন তিনি।
দক্ষিণ সুরমা থানার ওসি আখতার হোসেন এর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, হামলার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। বিআরটিসি কর্তৃপক্ষ বাস চালাতে চাইলে পুলিশ তাদের সহায়তা করবে।
প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ভিডিও কনফারেন্সে সিলেট-শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জ রুটে বিআরটিসি বাস সার্ভিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এ দুই সড়কে বাস সার্ভিস চালু হওয়ার পেছনে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ.কে আব্দুল মোমেনেরও। উদ্বোধনের পর আবেগাপ্লুত হয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানাতে ভুলেননি। কিন্তু উদ্বোধনের ৫ দিনের মাথায় বন্ধ হলো বাস সার্ভিস।
খোঁজ নিয়ে আরো জানা গেছে, বিআরটিসি সিলেট ডিপোতে ৩০টি নতুন বাস রয়েছে। এরমধ্যে সুনামগঞ্জ রুটে ৪টি, সিলেট ভোলাগঞ্জ সড়কে ১টি এবং সম্প্রতি নতুন করে সিলেট- শ্রীমঙ্গল ও হবিগঞ্জ সড়কে প্রথম অবস্থায় ২টি বাস নামানো হয়। পর্যায়ক্রমে ১২টি বাস নামানোর কথা ছিল। বাসগুলো সিলেটের কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল কদমতলী থেকে দুইরুটে প্রতিদিন চলাচল কথা ছিল।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, শীততাপ নিয়ন্ত্রিত বাসগুলোতে সিলেট- মৌলভীবাজার- শ্রীমঙ্গল রুটের ভাড়া যথাক্রমে ২৩৫ টাকা (শ্রীমঙ্গল) ও ১৮০ টাকা (মৌলভীবাজার) এবং সিলেট- হবিগঞ্জ রুটের এসি গাড়ির ভাড়া ২৭৭ টাকা। তবে, শীতকালীন সিলেট- হবিগঞ্জ রুটের এসি বাসের ভাড়া নেয়া হবে ১৮০ টাকা ও মৌলভীবাজারে ১৪০ থেকে ১৬০ টাকা ও শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত ১৭০ থেকে ১৮০ টাকা পর্যন্ত নেয়ার পরিকল্পনা ছিল বিআরটিসি কর্তৃপক্ষের।

মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন