একুশের ভাবনা মুহম্মদ আজিজুল হক চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। মহান ভাষা শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এটি আমাদের জাতির ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। আমাদের ইতিহাস সংগ্রামের গৌরবে গৌ্রবান্বিত। সেই সংগ্রামী ইতিহাসের একটি বিশেষ মাইলফলক অধ্যায় হচ্ছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন।  ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজদের হাতে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে যে স্বাধীনতাসূর্য অস্ত গিয়েছিল ১৯৪৭ সালে আমাদের জন্য তার পুনরোদয় ঘটে নি। পুর্ব পাকিস্তানের মানুষদেরকে প্রকৃ্ত স্বাধীনতা লাভের জন্য সংগ্রাম করতে হয় আরো চব্বিশ বছর। এই চব্বিশ বছরের সুদীর্ঘ সংগ্রামের প্রথম বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষা সৈ্নিকদের অনেকেই সে যুদ্ধে প্রাণ উৎসর্গ ক’রে রচনা ক’রে যান আমাদের প্রকৃ্ত স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধের ব্যাপক পটভূমি।  সেদিনের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই আসে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ও যুক্তফ্রণ্টের বিজয়, যা মুলত ছিল পাকিস্তানি শোষণ ও শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার প্রতিবাদ ও স্বাধিকার অর্জনের এক মহাপ্রয়াস। কিন্তু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে প্রাদেশিক সেই মন্ত্রীসভা দু’মাসও টেকে নি। এরপর আসে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তুরের নির্বাচন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে, ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ। অবশেষে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মহাবিজয়ের মাধ্যমেই আমাদের প্রকৃ্ত স্বাধীনতার অরুণোদয় ঘটে।  জাতি হিসেবে আমরা বাংলাদেশীরা পৃ্থিবীতে অনন্য। আমাদের রয়েছে অফুরন্ত প্রাণশক্তি, অন্তহীন সৃজনশীল আবেগ। বিজ্ঞান আমাদের বেগ দিলেও আবেগ খুব একটা কেড়ে নিতে পারে নি। আর আমাদের গভীর দেশপ্রেমের শিকড় প্রোথিত আমাদের এই সহজাত আবেগে। আমরা জন্মগতভাবেই অবিচার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। এতদঞ্চলের জনগোষ্ঠী কোনোদিনই বহির্শাসন বা পরশাসন মনেপ্রাণে মেনে নেয় নি। আমাদের এই উপমহাদেশে বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামেও আমরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছি; দিয়েছি বুদ্ধিগত নেতৃত্ত। ১৯০৬ সালে ঢাকার মাটিতেই নিখিল ভারত মুসলিম লীগ জন্মলাভ করে। জাতি হিসেবে আমরা অজেয়। তাই পাকিস্তানের স্বাধীনতার পরপরই ১৯৪৮ সালে শাসকগোষ্ঠী যখন আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের প্রাণের ভাষা, বাংলাকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করে এবং সে স্থলে পরভাষা চাপিয়ে দেবার প্রচেষ্টা চালায়, আমাদের অগ্রজরা সেই মুহূর্ত থেকেই হয় প্রতিবাদ মুখর। তাঁরা বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে আন্দোলন শুরু করে। সেই আন্দোলনই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয় ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে।  ভাষাশহীদেরা বাংলাভাষার জন্য তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন ১৯৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারি; অর্থাৎ, আমাদের স্বাধীনতাপূর্ব সময়ে। ১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ফলে দেশের রাজনৈ্তিক পটভূমি সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে যায়। তখন থেকে বাংলাদেশ পৃ্থিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং বাংলা আমাদের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হয়। আজ আর আমাদের মায়ের ভাষা, আমাদের মুখের ভাষা, বাংলাভাষার ওপর কোনো সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ নেই। সময়ের আবর্তনে বাংলাভাষা, বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি, বাংলাভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা, ইত্যাদি, বাংলাদেশে বিস্তার ও ঋদ্ধিলাভ করেছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান হচ্ছে বাংলাভাষায়। এ প্রেক্ষাপটে, স্বাধীনতাপূর্ব ভাষা আন্দোলন ও তার শহীদদের স্মৃতি জাতির মানসপটে ম্লান হয়ে আসতে পারতো; স্তিমিত হয়ে যেতে পারতো শহীদ দিবস পালন। কিন্তু তা তো হয়ই নি; পক্ষান্তরে, কালের পরিক্রমায় এই দিবস পালন আরো বিকাশ ও ব্যাপ্তিলাভ করেছে। কিন্তু কেন? কারণ অনেক কিছুই হতে পারে। তবে একটি কারণ নিহিত রয়েছে আমাদের জাতির অফুরান আবেগময় সৃজনশীল প্রাণশক্তিতে; সন্দেহ নেই। আমরা প্রাণোচ্ছল, প্রাণচঞ্চল, কর্মমুখর এক জাতি। একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা সেই প্রাণশক্তিরই বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখি। দেখি প্রাণের প্রবল প্লাবন, দেখি প্রজ্জ্বলিত বহ্নি। আমাদের জাতির ইতিহাস, আর আমাদের যুবসমাজ, বিশেষ ক’রে আমাদের ছাত্রসমাজের ইতিহাস, এক ও অভিন্ন। অতীতের মতো ভবিষ্যতেও জাতির যে কোনো মহাসংকটে, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব বা রাষ্ট্রভূমির অখন্ডতার বিরুদ্ধে যে কোনো চ্যালেঞ্জে প্রাণশক্তির এই প্লাবন, এই প্রাণবহ্নি কার্যকর হয়ে উঠবে, সকল সংকট হতে এ দেশ ও জাতিকে উদ্ধার করবে। আজ সারা পৃথিবী আমাদের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে অবগত। ১৯৯৯ সালে এ দিবস আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃ্তি পাওয়ায় আমাদের শহীদ দিবস এক আন্তর্জাতিক মাত্রা লাভ করেছে এবং হয়েছে অধিকতর গৌ্রবান্বিত। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একদিকে যেমন পৃথিবীর সব জাতিগোষ্ঠীদেরকে তাদের নিজ নিজ মাতৃভাষাকে ভালো্বাসতে এবং তার উন্নয়নে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করছে, অন্যদিকে তা আমাদেরে ভাষা শহীদদেরকে বিশ্বের ইতিহাসে অমর করে রেখেছে। আজকের এই দিনে আমরা যেন জাতির জন্য ভাষা শহীদদের সর্বোচ্চ ত্যাগের কথা কৃ্তজ্ঞতাভরে স্মরণ করি এবং তাঁদের বিদেহী আত্মার শাশ্বত শান্তি কামনা করি। সেই সাথে সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল ভাষাসৈনিককে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতির জন্য অনুপ্রেরণার এক অক্ষয়, অফুরন্ত ও চিরন্তন ফল্গুধারা হয়ে থাক। মাতৃভাষা, মাতৃভূমি, নিজ জাতি তথা সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে যেন আমরা এই দিবসের অনুপ্রেরণায় বলীয়ান হয়ে কাজ করতে পারি –এই হোক আমাদের কামনা।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন