ইতিহাসবিদ খাজিম আহমেদ রচিত 'পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা' উদার আকাশ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত গবেষণা গ্রন্থটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করলেন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মানস কুমার সান্যাল, সহ উপাচার্য অধ্যাপক গৌতম পাল, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক দেবাংশু রায় ও গবেষক-প্রকাশক-সম্পাদক ফারুক আহমেদ। উপাচার্যের কার্যলয়ে মঙ্গলবার নয় মার্চ বইটি প্রকাশ করে উপাচার্য ও সহ উপাচার্য উচ্চসিত প্রশংসা করেন গবেষণা গ্রন্থটির।
পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমানদের অন্তবিহীন সমস্যা, তার আত্মানুসন্ধান বা সমাধানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দুরের কথা, ‘কওম’-গত আন্তরিক উদ্যোগও লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠেনি। যারা বিষয়টি নিয়ে ভাবিত, সদর্থে চিন্তাভাবনা ও দায়বদ্ধ থাকাটা জরুরি বলে মনে করেন, তাঁরা জানেন যে কেন একটি জাতিসত্তা এতো উপেক্ষিত, শিক্ষায় অনগ্রসর, কেন এতো দরিদ্র, আর কেনই বা মুসলমান বুদ্ধিজীবী সমাজ স্ব-সম্প্রদায়ের সমস্যাবলির স্বরূপ উদঘাটনে ও নিরসনের দিক নির্দেশ সম্পর্কে আগ্রহী নন।
হালকা একটি আলোর রেখা সম্প্রতি দৃষ্টিগোচর হয়ে উঠছে। কয়েকজন সমাজবিজ্ঞানী আলোচ্য সমস্যাবলী নিয়ে গবেষণা করছেন এবং গ্রন্থাকারে তা পাঠকসজ্জনের সামনে পেশ করছেন। এঁদের মধ্যে খাজিম আহমেদ; এই উপমহাদেশ বিষয়ক ইতিহাসবেত্তা গবেষক, দেশ-বিভাগ পরবর্তী পশ্চিমবাংলার কঠোরভাবে একেশ্বরবাদী জাতিসত্তার মর্যাদার অন্বেষক, অনন্যসাধারণ প্রাবন্ধিক; বিশিষ্টতম।
এই জাতীয় কাজ আগে হয়নি কখনও, প্রকাশক হিসেবে ফারুক আহমেদ সে দাবী করছেন না। সোজাসুজি বলা যেতে পারে, এই প্রকাশনার মতো নির্মোহ বিশ্লেষণ এর আগে হয়নি।
খাজিম আহমেদ পুঙ্খানুপুঙ্খ নিরীক্ষণ মারফত যথার্থ সত্যটা তুলে এনেছেন। এই খানেই তাঁর বিশেষত্ব।
‘উদার আকাশ’-প্রকাশনের পৃষ্ঠপোষক আর শুভানুধ্যায়ীদের সামনে এমন একটি সাহিত্য-নির্মাণ হাজির করতে পেরে প্রকাশক হিসেবে ফারুক আহমেদ ব্যক্তিগতভাবে গর্বানুভব করছেন।
“পশ্চিমবাংলার বাঙালি মুসলমান : অন্তবিহীন সমস্যা” নামক প্রবন্ধগ্রন্থে ঐতিহাসিক খাজিম আহমেদ, একটি জাতিসত্তার ইতিহাস, উৎপত্তি-বিকাশ, রাজনৈতিক অবস্থান, সামাজিক প্রেক্ষাপট, সাংস্কৃতিক অধৌবিকাশ, ধর্মীয় পরিচয়ের প্রশ্নে উপেক্ষা, ‘মিশ্র সংস্কৃতি’ বা ‘কমপোজিট কালচার’-এর অনিঃশেষ গুরুত্ব, অর্থনৈতিক নিঃসীম দুর্বলতা সর্বোপরি মানবীয় মর্যাদা নিয়ে ‘বেঁচে-বর্তে’ থাকার প্রয়োজনে পরম সাদরে লালিত ধর্মনিরপেক্ষতা কেন প্রয়োজন– ইত্যাকার বিষয় নিয়ে বিস্তৃত চর্চা করেছেন। অগণন প্রবন্ধাদির মধ্যে থেকে ১৭ টি রচনা নিয়ে গ্রন্থটি প্রকাশিত।
প্রায় অর্ধ-শতকের ওপর তিনি সহৃদয় পাঠকবর্গের সঙ্গে রয়েছেন। সাবেক বাঙালিয়ানা, মিশ্র-সংস্কৃতি আর সমন্বয়ে বিশ্বাসী খাজিম আহমেদ কলকাতা কেন্দ্রিক প্রায় প্রত্যেকটি দৈনিক সংবাদপত্রসহ বিস্তর লিটল ম্যাগাজিনে কাহন কাহন লিখেছেন। সুজন পাঠক আর বিদ্বৎসমাজের স্বীকৃতি তাঁকে বিশিষ্ট করে তুলেছে।
সঠিক ইতিহাস রচনা করতে গেলে কোনও পক্ষ, কোনও ধর্ম ও মতবাদের প্রতি বিশেষ আস্থা রাখা যে সর্বসময়ে উপেক্ষণীয়, তা তাঁর রচনায় বারে বারে পরিস্ফুট। যেমন বর্তমান গ্রন্থে ‘সেকুলারিজমের সওয়াল’ – নামে একটি প্রবন্ধ থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত তিনি লিখেছেন, “এই দেশীয় মুসলমান সমাজের বেদনা এইখানে যে, স্বধর্মী কোনও ব্যক্তিত্ব তার সমাজের দুর্বলতার দিকটি যুক্তি ও সহানুভূতির সঙ্গে পর্যালোচনা করেন নি।........ সাধারণভাবে মুসলিম নেতৃত্ব সস্তায় কেল্লাফতে করার জন্য এমন সব দাবি বা সমস্যার কথা তোলেন, যার ফলে অমুসলমানরা (এমনকি প্রগতিশীল অংশও) মুসলমানদের থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।........ শুধু মুসলমানদের নিয়ে যদি কেউ একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলতে চান, তাহলে সুনিশ্চিতভাবে তা হবে মুসলিম স্বার্থ বিরোধী।...... একমাত্র জন্মের সুবাদে মুসলমান নেতারা মুসলমানদের স্বার্থরক্ষা করতে সমর্থ, সাধারণ উপেক্ষিত মুসলমান সমাজ আর কতকাল এই ধরনের প্রচারের শিকার হবেন, তা আমাদের জানা নেই।”
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন