চা বাগান ও টিলা বেষ্টিত ঐতিহ্যবাহী কমলগঞ্জ

কে এম আবুতাহের চৌধুরী ||

ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ কমলগঞ্জ মৌলভীবাজার জেলার একটি উপজেলা ।ধলাই নদী বিধৌত ,চা বাগান ও টিলাএ  বেষ্টিত  এ উপজেলার  রয়েছে অনেক সুনাম ও ইতিহাস ।১৯২২ সালের ১০ই জানুয়ারী বৃটিশ সরকারের নেটিফিকেশন অনুযায়ী কমলগঞ্জ থানার সৃষ্টি হয় । বাংলাদেশ সরকারের বিকেন্দ্রিকরন নীতির আওতায় ১৯৮৩ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর কমলগঞ্জ উপজেলা হিসাবে ঘোষিত হয় ।
ইতিহাস পাঠে জানা যায়,নওগাঁর অন্তর্গত কিংকরী নাথ চৌধুরীর স্থানীয় জমিদারির বিচক্ষণ নায়েব কমল নারায়ন রায় ১৩০৬ বাংলার দিকে পানিশ্য মৌজায় ধলাই নদীর তীরে কমলগঞ্জ নামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেন ।কালের পরিক্রমায় কমলগঞ্জ বাজার বন্ধ হয়ে গেলেও কমলগঞ্জ নামটি এখনও ঠিকে আছে।
কমলগঞ্জের আয়তন হচ্ছে ১৮৭ বর্গ মাইল ।মৌলভীবাজার জেলার দক্ষিণ পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত এ উপজেলার উত্তরে মৌলভীবাজার,কুলাউড়া ও রাজনগর উপজেলার অংশ বিশেষ ,পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও কুলাউড়া,দক্ষিণে ত্রিপুরা রাজ্য এবং পশ্চিমে শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার উপজেলা অবস্হিত ।এ উপজেলায় রয়েছে বিস্তীর্ণ পাহাড়ি এলাকা ,উঁচু নীচু টিলা   ভূমি ,সংরক্ষিত বনান্চল ও ভানুগাছের পাহাড় ।দক্ষিণের টিলা ভূমিতে রয়েছে ১৫টি চা বাগান ।
১৮৮২ সালে এ উপজেলা ইটা ,আলীনগর,শমশের নগর ,আদমপুর ও ভানুগাছ পরগনার বিভক্ত ছিলো।তালুকের সংখ্যা ছিলো   ৪ হাজার ৭ শত ৫৯ ।এখানে অনেক নিস্কর ভূমি ছিল ।
এ উপজেলায় মুসলিম, হিন্দু ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের পাশাপাশি বসবাস করেন মনিপুরী ও খাসিয়া জনগোষ্ঠীর লোক।ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত চা শ্রমিকদের রয়েছে বসবাস ।মরমি সাধক মফিজ শাহ ,কালা শাহ,ভাষা সৈনিক ও সাবেক এম এন এ মোহাম্মদ ইলিয়াছ,আন্তর্জাতিক লোক সাহিত্য বিশারদ চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষণ,খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও লেখক আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্ন কাব্যবিনোদ,প্রথম মুসলিম স্নাতক মো: আব্দুল আজিজ বিএল,আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিদ্যায় প্রথম স্থান অধিকারী আব্দুল ওয়াহাব এম এস সি ও রসায়ন বিদ্যায় প্রথম স্থান অধিকারী অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস খান ,আলহাজ কেরামত আলী এম এল এ,দানশীল জমিদার নব কিশোর দাস চৌধুরী ,খানবাহাদুর ডা: বজলুল হাসান বিএমএস ,প্রথম জজ নুরুল হাসান ,প্রথম শ্রেণীতে অংকে এমএসসি পাশ রবীন্দ্র কুমার সিংহ ,উপসচিব মঈন উদ্দিন আহমদ ,মৌলভীবাজার জেলার প্রথম সচিব সাইয়িদ আহমদ মাহমুদ ,পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রথম প্রতিনিধি সাবেক চার্জ দ্যা এফেয়ারস সৈয়দ আব্দুন নবী,উইং কমাণ্ডার সবর উদ্দিন আহমদ ,সিলেটের প্রথম ডিএসসি ড: শশী ভূষণ মালী ,ও চা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা মফিজ আলী হচ্ছেন কমলগঞ্জ উপজেলার কৃতি সন্তান ।
১৩০৭ বাংলায় জমিদারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কমলগঞ্জের ভানুবিলে প্রজা বিদ্রোহ হয়েছিল ।এর নেতৃত্বে ছিলেন পন্চানন সিংহ ,কাশেম আলী ,বৈকুন্ঠ শর্মা  প্রমুখ ।এ বিদ্রোহের সময় জমিদার আলী আমজাদ খানের অত্যাচারী নায়েব রাসবিহারী নিহত হন । বৃটিশ সরকার ঘটনার তদন্ত করে ।১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে এ উপজেলাবাসীর রয়েছে অনেক অবদান ।তৎকালীন ইপিআর জোয়ান ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে শমশের নগরে পাকবাহিনীর সম্মুখ সমরে যুদ্ধ হয় ।এ যুদ্ধে ১২ জন পাক সেনা হতাহত হয় ।৪ ডিসেম্বরের যুদ্ধে কমলগঞ্জে ৪ জন মুক্তিযাদ্ধা শহীদ হন ।বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জেড ফোরস নিয়ে এ অন্চলে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ।
শিক্ষা দীক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে এ উপজেলাবাসীর রয়েছে অনেক সুনাম ।জারি গানের পথ প্রদর্শক আছাদ মিয়া ,মোহাম্মদ আগলুছ ও রুশমত মিয়ার সুরেলা কন্ঠ লোকের মুখে মুখে।গাজীর গীতে নাম করেছেন ,সফদর শাহ ,আছদ উল্লাহ ও ঐছত উল্লাহ ।নৃত্যে মনিপুরীদের নাম ডাক ।থিয়েটার ও যাত্রাগানে মুন্সীবাজার এলাকার ছিল খ্যাতি ।শিক্ষায় অনেক সুখ্যাতি অর্জন করেছেন উপজেলাবাসী।
সাহিত্য অঙ্গনে ছিলো অনেক খ্যাতি ।মুন্সী আশরাফ হোসেন সাহিত্যরত্ন একাই লিখেছেন ইতিহাস ভিত্তিক ও বাংলা সাহিত্যের অমর রচনা সম্বলিত ২৪টি বই ও পুঁথি।চৌধুরী গোলাম আকবর সাহিত্যভূষণ ,চৌধুরী হারুন আকবর ,কবি নওয়াব জাহান ,কবি আবু কয়ছর খান ,অধ্যাপক শামস উদ্দিন আহমদ ,অধ্যাপিকা মন্জু শ্রী রায় ,রস সাহিত্যিক আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী ,কবি শহীদ স্বাগ্নিক ,সাংবাদিক ইসহাক কাজল ,সাংবাদিক মীর লিয়াকত আলী ,প্রাবন্ধিক নন্দলাল শর্মা ,সিতারা বেগম,গোলাম মোস্তফা চৌধুরী ,রঘুনাথ দাস প্রমুখ অনেক বই লিখেছেন ।
মৌলভীবাজার জেলার ৫২ বর্গ মাইল সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ১৩ বর্গ মাইল কমলগঞ্জে রয়েছে ।শমশের নগর বিমান বন্দর রয়েছে কমলগঞ্জে ।যা আজ অবহেলিত অবস্থায় পড়ে আছে ।
প্রবাসীরা উপজেলার উন্নয়নে অনেক  অবদান রাখছেন ।এমপি উপাধ্যক্ষ  আব্দুস শহীদ,শায়খুল ক্বুররা মাওলানা আলী আকবর সিদ্দিক ,ডা: চেরাগ উদ্দিন আহমদ ,শিক্ষাবিদ ফখর উদ্দিন চৌধুরী ,মরহুম সাংবাদিক মতিউর রহমান ,ব্যাংকার ও সমাজসেবী সৈয়দ সুহেল আহমদ ,একাউন্টেন্ট শওকত চৌধুরী ,সাংবাদিক শাহিন খান ,কমিউনিটি নেতা ফারুক আহমদ ও আব্দুল হান্নান, সাহিত্যিক ও সুলেখক সৈয়দ মাসুম  এ উপজেলার কৃতি সন্তান ।আরো অনেক প্রবাসে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন ।সৈয়দ মাসুম ১০০ জনের জীবনী নিয়ে একটি বই প্রকাশ করতে যাচ্ছেন ।
আমার পূর্ব পুরুষ শাহ ওয়ালি মোহাম্মদ সাতশ’ বছর আগে আরব দেশ থেকে এসে এ উপজেলার ছয়ছিরি মৌজায় প্রথমে বসতি স্থাপন করেন ।সেখানে শাহ মোহাম্মদ ও শাহ ফাজিল মোহাম্মদ নামে আমাদের দুটি তালুক ছিল ।পরে ইটা সিংকাপনে স্থানান্তরিত হন । আমার দাদা মুন্সী শাহ নঈমুদ্দিন আহমদ চৌধুরী ভানুগাছের গবিন্দপুর চৌধুরী বাড়িতে বিবাহ করেন ।আমার দাদীর নাম ছিল ফাতেমা খাতুন চৌধুরী।এ দাদীর গর্ভেই জন্ম নিয়েছেন সিংকাপনী মাওলানা ব্রাদারসের  অন্যতম খ্যাতনামা আলেম মাওলানা আব্দুর রহমান চৌধুরী সিংকাপনী ,মাওলানা হাফেজ আব্দুল কাদির চৌধুরী সিংকাপনী ,মাওলানা আব্দুল খালিক চৌধুরী সিংকাপনী ও মাওলানা আব্দুল আজিজ চৌধুরী সিংকাপনী ।সুতরাং এ উপজেলাবাসীর সাথে আমাদের পারিবারিক সম্পর্কও রয়েছে ।

কমলগঞ্জের দু:খ ও আশির্বাদ হচ্ছে ধলাই ।এ উপজেলা জাতীয় উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখছে ।প্রবাসীরা অনেক উন্নয়ন করছেন ।তারপরও উপজেলাবাসী দারুনভাবে অবহেলিত ।শমশের নগর বিমান বন্দর চালু হচ্ছেনা ।মৌলভীবাজার - শমশের নগর রাস্তার বড় বেহাল অবস্থা ।বন্যা নিয়ন্ত্রণ পুরাপুরি করা হয়নি ।চা শ্রমিকদের জীবন মান খুবই নিম্নমানের ।সঠিক মজুরী দেওয়া হচ্ছেনা ।যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ।তাই এ উপজেলার উন্নয়নে সরকারকে জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন