নজরুল ইসলাম ll
আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যহীনতা প্রায়ই উপমা হয়ে চোখে ভাসে। আমাদের ভাবতে শেখায় আমরা কতটা অকৃতজ্ঞ স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছি। প্রয়াতঃ কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমদ মারা যাবার আজ দুই বছর পূর্তি। প্রয়াতঃ জ্ঞানীগুণী এই ভদ্রলোককে নিয়ে একটু স্মৃতিচারণ করব বলে গেল দুই বছর ধরে তারিখ হচ্ছে, সময় হচ্ছে না, very unfortunate. এজন্যই বললাম আমরা বড়ই স্বার্থপর অকৃতজ্ঞ।
আমার সদ্য প্রয়াত পিতা আব্দুন নুর মাস্টার মহোদয় বলতেন, অকৃতজ্ঞতা স্বার্থপরতা ইহা মানুষের সহজাত স্বভাব। হতাশ হওয়ার কিছু নেই, কার্য চলবে। আজ সৈয়দ আবু জাফর আহমদের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। স্মৃতিপটে তাহার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অনেক কিছুই ভাসছে। বঞ্চনা শোষণ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা আর মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এক লড়াকু সৈনিকের নাম সৈয়দ আবু জাফর আহমদ।
শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করছি জেলার কৃতিমান এই রাজনৈতিক নেতাকে।
প্রয়াতঃ কমরেড আবু জাফর আহমদ,সম্পর্কে আমার আত্মীয় হওয়াতে একান্ত পারিবারিক ভাবেও তিনির সম্পর্কে আমার জানার সুযোগ হয়েছে। নিঃসন্দেহে তিনি ছিলেন এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ। ছিলেন একজন ভাল পিতা, একজন ভালো স্বামীও। সৈয়দ আবু জাফর ছিলেন একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন- সংগ্রাম ও অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল আন্দোলনের একজন নির্ভীক সৈনিক। সর্বোপরি একজন সজ্জন পরীক্ষিত সু -শিক্ষিত মার্জিত ভদ্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রয়াত আবু জাফর আহমেদের অনেক সুনাম রয়েছে।
সৈয়দ আবু জাফর আহমদ ১৯৫৪ সালের ১১ জুলাই মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। শিক্ষা জীবন শুরু হয় ১৯৫৯ সালে সৈয়ারপুর লক্ষ্মীবালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬১ সালে মৌলভীবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ১৯৬৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে। সৈয়দ আবু জাফর আহমদ ১৯৭০ সালে মৌলভীবাজার কলেজ সংসদ নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে একই সংগঠনের প্রার্থী হিসেবে একই কলেজ সংসদে জিএস নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি- ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সদস্য হিসেবে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের যোদ্ধা হিসেবে চা শ্রমিক হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালে প্রথম কারাবন্দি হন। ওই বছরই তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন মৌলভীবাজার মহকুমা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ১৯৭৪ সালে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সপরিবারে জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ সংগঠিত করতে গিয়ে ১৯৭৫ সালে তিনি কারাবরণ করেন। বিনা বিচারে প্রায় এক বছর হাজতবাস করে ১৯৭৬ সালে মুক্তিলাভ করেন। এছাড়া স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের আমলেও তিনি কারাবন্দি হন।
সামরিক স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, কৃষক, ক্ষেতমজুর, চা শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, শব্দকার জনগোষ্ঠী মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়, স্বাধীনতা বিরোধীদের বিচার, জাতীয় সম্পদ রক্ষা, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি ছিলেন সামনের কাতারে। তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির ২০০২ সালের ঢাকা- বিবিয়ানা লংমার্চে তিনি ছিলেন সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক। পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতিবিদ সৈয়দ আবু জাফর আহমদ ভারত, নেপাল, সোভিয়েত ইউনিয়ন(রাশিয়া), চীন, ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, হংকং, তুরস্ক প্রভৃতি দেশের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া ১৯৭৯ সালে তিনি এক বছরের জন্যে মার্ক্সবাদ এবং লেনিনবাদ সম্পর্কে উচ্চতর জ্ঞান লাভের জন্যে জার্মানিতে গমন করেন।
মফস্বল শহর থেকে রাজনীতি করে দেশের অন্যতম একটা প্রাচীন রাজনৈতিক সংগঠন “বাংলাদেশের কমিউনিস্ট,পার্টির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। অসুস্থতাজনিত কারণে সৈয়দ আবু জাফর আহমদ ২০১৭ সালে তিনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে আমৃত্যু প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আমি তখন স্কুলের ছাত্র, মাঝে-মধ্যে মৌলভীবাজার জেলা সদরে আসা হতো। মেহনতী মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে মৌলভীবাজার চৌমুহনীতে দাঁড়িয়ে প্রয়াতঃ সৈয়দ আবু জাফর জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতেন- কথা বলার বাচন ভঙ্গি সবাইকে আকৃষ্ট করতো, মানুষ জড়ো হয়ে তাঁর বক্তব্য শুনতে, আমি রিক্সা দাঁড় করিয়ে প্রায়ই তাঁর বক্তব্য শুনতাম, এ যেন হেমিলিওনের বাঁশিওয়ালার মতো কথা বলার জাদুকরী কৌশল ছিল । আমার কাছে প্রায়ই মনে হতো ,এখনো মনে হয় সৈয়দ আবু জাফর আহমদ ছিলেন দেশের সেরা কয়জন সুবক্তার মধ্যে অন্যতম একজন।
ঝাপসা মনে পড়ছে ,আমি ম্যানেজমেন্ট অনার্স শেষ করেছি, মাস্টার্স চলছে, সালটা ছিল ২০০১,বলতে হয় আমার বিয়ের বছর। মৌলভীবাজারের উত্তর মুলায়ম গ্রামের একটি পরিবারের সাথে আমার বিয়ে নিয়ে কথা হচ্ছে। বিদেশিনী কন্যার পরিবার জানতে চাইলেন মৌলভীবাজারে জেলা সদরে আমাদের কোনো আত্মীয়-স্বজন আছে কি না? বললাম, আমার খালাতো বোন কাউসার পারভিন PTI ইন্সট্রাক্টর, সৈয়দ আবু জাফর ভাইয়ের স্ত্রী ,আরো অনেকে আছেন। পরদিনই তারা আমার সম্পর্কে জানার জন্য আবু জাফর ভাইয়ের বাসায় চলে যান। শুনেছি, জাফর ভাই নাকি দীর্ঘশ্বাসে বলেছেন নজরুলও লন্ডন চলে যাচ্ছে! আমাকে অনেক স্নেহ করতেন, বলতেন লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে করে দেশের বাইরে চলে গেলে এই দেশটি চলবে কিভাবে? একজন সত্যিকারের দেশ প্রেমিক ছিলেন, undoubtedly.
কমরেড সৈয়দ আবু জাফর লেখালেখিতেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইয়ে নিবেদিত রাজনীতিবিদ সৈয়দ আবু জাফর আহমদ ২০১৯ সালের ২৯ মে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। আজ ছিল তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। আমার বিশ্বাস কমরেড সৈয়দ আবু জাফর বেঁচে থাকবেন তার কর্মে- বছরের পর বছর। দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা। আল্লাহ যেন তাহার পরিবারের সকল সদস্যকে শোক সহিবার তৌফিক দান করেন।
লেখক: ফ্রিল্যান্স জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেল্থ সার্ভিস (NHS) লন্ডন, মেম্বার, দ্য ন্যাশনাল অটিস্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন