তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া'র ৫২তম মৃত্যুবার্ষিকী শ্রদ্ধা



।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
বাংলাদেশের আকামের এক ধ্রুব তারার না হলো তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। একজন প্রতিথযশা সাংবাদিক, লেখক ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। বাংলার গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে তার রয়েছে নানা অবদান এবং শিকার হয়েছেন নির্যাতনের। মানুষের কথা কলমের কালিলে তুলে ধরতে গিয়ে তিনি ‘মোসাফির’ ছদ্মনাম ধারন করেছিলেন। মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও তিনি কারাবরন করেছেন কয়েক বছর।

সাংবাদিকতা জগতের এই উজ্জল নক্ষত্র তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে বলা হতো গণতন্ত্রের মানষপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মসি। যিনি কলম দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে রাজনৈতিক আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কলমযোদ্ধা ছিলেন। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া তাঁর পেশাদারী জীবন ও কর্ম দিয়ে রাজনীতি ও সাংবাদিকতার একটি সেতুবন্ধন তৈরি করেন। আর এভাবেই তিনি একদিন এদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে একজন অন্যতম একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন জাতীয় সংগ্রামসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রেরণাস্থল হয়ে উঠেছিলেন।

যে আদর্শের জন্য তিনি বাংলার মুক্তি সংগ্রাম করেছিলেন মৃত্যুর কাছে হার মেনে তা দেখে যেতে পারেন নাই। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ দেখে যেতে পারেননি। দেখে যেতে পারেননি কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শের স্বাধীন বাংলাদেশ মুখ। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মরণে করতে হলে অবশ্যই তফাজ্জাল হোসেন মানিক মিয়াকে স্মরণ করতে হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার কথা বলেছেন তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নামক গ্রন্থে। তিনি তাঁদের বন্ধুত্বের সম্পর্কের কথা বলেছেন এভাবে, "একদিন ভাসানী সাহেব ও আমি কোর্টে যেয়ে দেখি মানিক ভাই দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের সাথে দেখা করার জন্য। আলাপ-আলোচনা হওয়ার পরে মানিক ভাই বললেন, নানা অসুবিধায় আছি, আমাদের দিকে খেয়াল করার কেউ নাই। আমি কি আর করতে পারব, একটা বড় চাকরি পেয়েছি করাচিতে চলে যেতে চাই, আপনারা কি বলেন। আমি (বঙ্গবন্ধু) বললাম, মানিক ভাই, আপনিও আমাদের জেলে রেখে চলে যাবেন? আমাদের দেখবারও কেউ বোধহয় থাকবে না। আমি জানতাম মানিক ভাই চারটা ছেলেমেয়ে নিয়ে খুবই অসুবিধায় আছেন। ছেলেমেয়েদের পিরোজপুর রেখে তিনি একলাই ঢাকায় আছেন। মানিক ভাই কিছু সময় চুপ করে থেকে আমাদের বললেন, না, যাব না আপনাদের জেলে রেখে।"

তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জন্ম গ্রহন করেন ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলা জেলার ভান্ডারিয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নোম মুসলেম উদ্দিন মিয়া। শৈশবেই মানিক মিয়ার মা ইন্তেকাল করেন। গ্রামের পূর্ব ভান্ডারিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুলে মানিক মিয়ার শিক্ষা জীবনের শুরু। সেখানে কিছুদিন পড়ার পর তিনি ভর্তি হন ভান্ডারিয়া হাই স্কুলে। স্কুল জীবন থেকেই তাঁর মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। তখন থেকেই তিনি ছিলেন সহচর-সহপাঠীদের কাছে ক্ষুদে নেতা। ভান্ডারিয়া স্কুলে মানিক মিয়া অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। তারপর চলে যান পিরোজপুর জেলা সরকারী হাই স্কুলে। সেখান থেকেই তিনি কৃতিত্বের সাথে মেট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৫ সালে মানিক মিয়া ডিস্টিংশন সহ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন।

লেখাপড়া শেষ করে তিনি পিরোজপুর জেলাসিভিল কোর্টে চাকরি শুরু করেন। চাকরি করার সময় তিনি একবার বরিশাল জেলা তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরওয়ার্দীর সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান। কোর্টের চাকুরীকালীন সময়ে জনৈক মুন্সেফ একদিন তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করেন। এই অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করে চাকুরি ছেড়ে দেন। এ চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি যোগ দেন করেন তৎকালিন বাংলা সরকারের জনসংযোগ বিভাগে বরিশাল জেলার সংযোগ অফিসার হিসেবে। সে চাকুরী ছেড়ে দেয়ার পর তিনি কলকাতার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অফিস সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন।

রাজনৈতিক প্রচারকে জনগণের কাছে নিয়ে যেতে একটি প্রচারপত্রের প্রয়োজন ছিলো এবং সেই চিন্তা থেকেই মানিক মিয়ার উদ্যোগে ১৯৪৬ সালে আবুল মনসুর আহমেদের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ‘দৈনিক ইত্তেহাদ’-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। এ পত্রিকার সাথে মানিক মিয়া মাত্র দেড় বছরের মতো যুক্ত ছিলেন। এই পত্রিকার মাধ্যমেই তাঁর গণমাধ্যম জগতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে পত্রিকাটি ঢাকায় নিয়ে আসার অনেক চেষ্টা করেন তিনি। কিন্তু তিনবার পত্রিকাটিকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশে বাধা দেয়া হয় এবং নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বার বার এভাবে পাকিস্তানি সরকার কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় শেষ পর্যন্ত পত্রিকাটি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন কর্তৃপক্ষ। মানিক মিয়াও তখন ঢাকায় চলে আসেন।

১৯৪৮ সালেই পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিরা মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে নামে। এই ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই বাঙালির পাকিস্তান মোহ কিছুটা কাটতে থাকে। ১৯৪৯ সালে মুসলীম লীগেরবিরোধী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। ঐ বছরই নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের মুখপত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় সাপ্তাহিক দৈনিক ইত্তেফাক। মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পত্রিকাটির আনুষ্ঠানিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৫১ সালের ১৪ আগস্ট থেকে মানিক মিয়া এই পত্রিকার পূর্ণ দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালে তাঁর সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক ইত্তেফাকে রূপান্তরিত হয়। এ সময়েই দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা আইয়ুব খানের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৫৯ সালে তিনি এক বছর জেল খাটেন।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের রূপকার বাংলার ছাত্র-জনতা, আর ভাষা আন্দোলন হতে উৎসারিত জাতীয়তাবাদের মুখপত্র হিসেবে লড়াই করতে থাকে ইত্তেফাক। ৫৪-এর সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার প্রচার করে এবং যুক্তফ্রন্টের মৌলিক দাবিগুলোকে গণমুখী করে ইত্তেফাক। মূলত যুক্তফ্রন্টের ইশতেহারকে নিয়ে পশ্চিমা শাসনের একটি বিরোধী শক্তির আবির্ভাবের জন্য ব্যাপক জনমত তেরি করে ইত্তেফাক, যা পশ্চিমাদের পরাজয়কে অনিবার্য করে তোলে। ৫৮-এর আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলনে মানিক মিয়ার ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক আন্দোলন তৈরি করে।

৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফার সবচেয়ে বড় সমর্থক ছিলেন মানিক মিয়া এবং মানিক মিয়ার ইত্তেফাক বাঙালির জাতীয় মুক্তির সনদ এই ছয় দফার সবচেয়ে বড় প্রচারপত্র হিসেবে মূখ্য ভূমিকা পালন করে  ছিল। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে পশ্চিমা শাসকদের রাজনৈতিক পরাজয়ের সাথে সাথে নৈতিকতারও চরম বিপর্য ঘটে, এখানেও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আবর্তনের মধ্যে মানিক মিয়া ছিলেন। ১৯৬৩ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এ সময় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ এবং নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর ফলে তার প্রতিষ্ঠিত অন্য দুটি পত্রিকা ঢাকা টাইমস ও পূর্বাণী বন্ধ হয় যায়। ১৯৬৩ সালে তিনি আন্তর্জাতিক প্রেস ইন্সটিটিউটের পাকিস্তান শাখার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

১৯৬৪ সালে কাশ্মীরে সৃষ্ট দাঙ্গা ঢাকায় ছড়িয়ে পড়লে তা প্রতিরোধে স্থাপিত দাঙ্গাপ্রতিরোধ কমিটির প্রথম সভাপতি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি ইত্তেফাকের রাজনৈতিক হালচাল ও পরবর্তী সময়ে মঞ্চে নেপথ্যে কলামে মোসাফির ছদ্মনামে নিয়মিত উপসম্পাদকীয় লিখতেন।

পূর্ব বাংলার স্বাধিাকারের প্রশ্নে মানিক মিয়া ছিলেন আপোষহীন ও উচ্চকন্ঠ। ‘রাজনৈতিক হালচাল’ ও ‘মঞ্চ নেপথ্যে’ শিরোনামে তাঁর লেখা উপসম্পাদকীয় কলাম এবং ‘মোসাফির’ ছদ্মনামে লেখা রাজনৈতিক নিবন্ধ পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘পাকিস্তানী রাজনীতির বিশ বছর’ এবং ‘নির্বাচিত ভাষণ ও নিবন্ধ’। শেরে বাংলা নগরের মানিক মিয়া এভিনিউ-এর নামকরণ তাঁকে সম্মান জানাতেই করা হয়েছে।

দীর্ঘ সংগ্রামের পর একটা সময় এসে মানিক মিয়া কিছুটা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়ে। এ অবস্থায় ১৯৬৯ সালে ২৬ মে এই ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েই তিনি প্রাতিষ্ঠানিক কাজে রাওয়ালপিন্ডি যান। সেখানেই ১৯৬৯ সালের ১ জুন রাতে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুর মাধ্যমে এক অকুতোভয় রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বের বর্ণাঢ্য জীবনের অবসান হয়।

একজন সাংবাদিক মানিক আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তিনি আমাদের মাঝে রেখে গেছেন তাঁর সংগ্রামী জীবনের অসীম অনুকরণীয় আদর্শ। কি করে দেশকে ভালোবাসতে হয়, কি করে বিপদে-আপদে দেশের মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয় তা শিখিয়েছেন তিনি। যতদিন এই বাংলাদেশ থাকবে, যতদিন লাল-সবুজের পতাকা থাকবে, যতদিন আদর্শবান সাংবাদিকের কথা বলা হবে, যতদিন সাহসী সাংবাদিকের কথা বলা হবে, ততদিন মানিক মিয়া আমাদের পথপ্রদর্শক হয়ে থাকবেন। সহাসী তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার অমর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

মন্তব্যসমূহ (০)


ব্রেকিং নিউজ

লগইন করুন


Remember me Lost your password?

Don't have account. Register

Lost Password


মন্তব্য করতে নিবন্ধন করুন