নজরুল ইসলাম ll
প্রায় ৭৫ বছর পূর্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জে, ইরভিং গ্রোভ নামক একজন আমেরিকান ভদ্রলোক মৌলভীবাজার জেলার শমশেরনগর বিমানবন্দরে কাজ করেছিলেন। নান্দনিক শমশেরনগর নিয়ে তিনির স্মৃতিপঠ ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন যা পড়ে আমি আবেগে আপ্লুত হয়েছি। আপনাদের সাথে মার্কিন ভদ্রলোকের ফিরে দেখা স্মৃতি ইতিমধ্যে একটি আর্টিকেল লেখনীর মাধ্যমে শেয়ার করেছি।
আজ প্রসঙ্গ ভিন্ন, "শমশেরনগর বিমানবন্দর পুনরায় চালু চাই। ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ দেশের বৃহত্তম বিমানবন্দরের ইতিহাস অনুসন্ধানে জানা যায়- ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় অভিযান চালানোর জন্য ব্রিটিশ সরকার মৌলভীবাজারের শমশেরনগর চা বাগানের ৬২২ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে একটি বিমানবন্দর গড়ে তোলে। ব্রিটিশ আমলে ওই বিমানবন্দরটি ‘দিলজান্দ বন্দর’ নামেই পরিচিত ছিল। বিমানবন্দরটিতে ৬ হাজার ফুট দীর্ঘ ও ৭৫ ফুট প্রশস্ত রানওয়ে রয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পর বিমানবন্দরটির নতুন নামকরণ করা হয় ‘শমসেরনগর বিমানবন্দর’। প্রশস্ত রানওয়ে, বিশাল পরিসর, উন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ও সব ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা থাকা এ বিমানবন্দরে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময় পর্যন্ত বিমান ওঠানামা করতো পরবর্তীতে বিমানবন্দরটিতে যাত্রীবাহী বিমান ওঠানামা বন্ধ হয়ে যায়।
দীর্ঘদিন থেকে অযত্ম-অবহেলায় অব্যবহৃতভাবে পড়ে আছে সিলেট বিভাগের শমসেরনগর বিমানবন্দরটি।
১৯৭০ সালে পিআইএ’র অভ্যন্তরীণ একটি ফ্লাইট সিলেট বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে শমশেরনগর বিমানবন্দরে জরুরী অবতরণকালে রানওয়ের কাছে দুর্ঘটনায় পতিত হয়। সেসময় বিমানবন্দরের ভেতরে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় এর বেশকিছু অবকাঠামো পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়।
১৯৭৫ সালে শমসেরনগর বিমানবন্দরে বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ ইউনিট খোলা হয়। পরবর্তী সময়ে এখানে বিমান বাহিনীর একটি পরীক্ষণ স্কুল স্থাপন করে চালু করা হয় বার্ষিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তখন থেকেই প্রয়োজন অনুযায়ী বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান ও হেলিকপ্টার ওঠানামা করছে।
১৯৯৫ সালে শমসেরনগর বিমানবন্দর থেকে এ্যারোবেঙ্গল এয়ার সার্ভিসের ফ্লাইট চালু করা হয়। কিন্তু পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাবে এ ফ্লাইট সার্ভিসটি যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। পরে এ প্রক্রিয়াও আলোর মুখ দেখতে পারেনি।
শেষবারের মতো ২০১৬ সালে তৎকালীন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এমপি শমসেরনগর বিমানবন্দরটি ফের চালুর উদ্যোগের বিষয়টি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সরকার ইতিমধ্যে শমশেরনগর বিমানবন্দর চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল কমিটির প্রতিবেদন পেলে পরবর্তী উদ্যোগ নেওয়া হবে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, কাঙ্খিত এই প্রক্রিয়াটি স্থবির হয়ে পড়ে আলোর মুখ দেখেনি।
অদ্য শমশেরনগর বিমানবন্দর পুনরায় চালুর দাবি ও দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে সিলেট বিভাগের সিনিয়র এমপি, শ্রীমঙ্গল-কমলগঞ্জ নির্বাচনী আসনের সাংসদ উপাধ্যক্ষ ডঃ আব্দুস শহীদ এমপি মহোদয় সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী জনাব মাহবুব আলীর সাথে। যা ফোনালাপে তিনি আমাকে নিশ্চিত করেছেন। মাননীয় এমপি মহোদয বলেছেন, মৌলভীবাজার জেলার ২৫ লক্ষ মানুষের প্রাণের দাবি শমশেরনগর বিমানবন্দর পুনরায় চালুর পক্ষে তাহার অবস্থান অনড়।
বর্তমানে শমশেরনগর বিমানবন্দরের অবহেলিত ও পতিত ভূমি ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয়েছে বিশাল কৃষি খামার। এখানে বিমানবাহিনীর রিক্রুটমেন্ট অফিসও খোলা হয়েছে। সংস্কার করা হয়েছে রানওয়ের অল্প কিছু অংশ। বিমানবন্দরটিতে প্রতিবছর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জাতীয় ক্যাডেট কোর বিমান শাখার সদস্যদের অগ্নিনির্বাপণ, প্রাথমিক চিকিৎসা, রাডার নিরাপত্তা, ফায়ারিংসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিমান বন্দরটি পুনরায় চালুর সকল অবকাঠামো রয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমশেরনগর বিমানবন্দরকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলের পর্যটন কেন্দ্রগুলো- এ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি। টিলাঘেরা সবুজ চা বাগান, ছায়া নিবিড় পরিবেশে অবস্থিত নয়নাভিরাম মাধবপুর লেক, ঝরনাধারা হামহাম জলপ্রপাত, মাগুরছড়া ডবলছড়া খাসিয়া পুঞ্জি, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী ধলই চা বাগানে অবস্থিত বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের স্মৃতিসৌধ, শিল্পকলা সমৃদ্ধ মণিপুরীসহ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জীবনধারা ও সংস্কৃতিসহ প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর এ জনপদ ইতিমধ্যে পর্যটকদের দৃষ্টি কেড়েছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সংরক্ষিত বনাঞ্চল সবচেয়ে দর্শনীয়, নান্দনিক ও আকর্ষণীয়। অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সবুজ বৃক্ষরাজি। এই উদ্যান পশুপাখি বন্যপ্রাণীর নিরাপদ আবাস স্থল। ১৯৯৬ সালে ১২৫০ হেক্টর এলাকা নিয়ে লাউয়াছড়াকে ঘোষণা করা হয় জাতীয় উদ্যান। এছাড়া জাতীয় উদ্যানে ৪৬০ প্রজাতির প্রাণিবৈচিত্র্যের ভেতর ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ৪ প্রজাতির উভয়চর প্রাণী, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি, ২০ প্রজাতির অর্কিড, ২০ প্রজাতির স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী এবং ১৭ প্রজাতির পোকামাকড় রয়েছে। আগর বাগান, বিরল প্রজাতির গাছ, নানা প্রজাতির পাখি ,পাখির ডাক, ছড়া, বনফুল, অর্কিড, চশমা বানর এগুলো এ বনের বিশেষ আকর্ষণ।
সংক্ষিপ্তভাবে জেলার নান্দনিকতাকে আলোচনা করলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি কৃপণতা করা হবে।
মৌলভীবাজার জেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে
ক্যামেরাবন্দি করে সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই শেয়ার করেন যা অবলোকনে মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কবিতার লাইনদুটি "আমি বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।
ঢাকা থেকে প্রায় সোয়া ২শ’ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে শমশেরনগর বিমানবন্দরের অবস্থান। ঢাকা থেকে সরাসরি ট্রেন অথবা বাসযোগে, এয়ারপোর্ট চালু হলে বিমান যোগে প্রবাসী অধ্যুষিত মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জ জেলার মানুষের জীবনমানে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। একই সাথে সংশ্লিষ্টদের দাবি ও ব্যবসায়ি উদ্যোক্তারা মনে করছে বিমানবন্দরটি পুণরায় চালুর উদ্যোগ নেয়া হলে সিলেট অঞ্চলের শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উৎকর্ষ সাধনের পাশাপাশি দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জেলার ২৫ লক্ষ মানুষ তথা আশপাশের জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণের দাবি প্রতি আপনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।
-------------------------------------------------------------------------------
নজরুল ইসলাম :জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) লন্ডন, মেম্বার, দি ন্যাশনাল অটিস্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন