নজরুল ইসলাম ll
গত বৃহস্পতিবার (৮ জুলাই) বিকেলে রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকার হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানার একটি ছয় তলা ভবনের নিচ তলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। অল্প সময়ের মধ্যে আগুন উপরের ফ্লোরগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। আগুন লাগার পর পরই ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে তিনজন মারা যান, আহত হন ১০ জন। পরদিন শুক্রবার বিকেলে আগুন নিভিয়ে ফেলার পর ৪৮ জনের পোড়া মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা, যা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম নিশ্চিত করেছে।
হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানার ছয় তলা ভবনটি আগুনে ধ্বংসস্তূপে রূপ নিয়েছে। পুড়ে যাওয়া হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানায় উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ভবনটি সম্পূর্ণ তল্লাশি করে আর কোনো মরদেহ কিংবা আগুন না থাকায় উদ্ধারকাজ সমাপ্ত ঘোষণা করেন।
রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকার আগুনে পুড়ে যাওয়া কারখানার ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ও বুয়েট থেকে বিশেষজ্ঞরা এসে ভবনটি পরিত্যক্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করবেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তা জানা যাচ্ছে।
কারণ
* ভবনটি ফায়ার সার্ভিস থেকে অনুমোদন নেয়নি।
* ভবনের ফায়ার সেফটি প্ল্যান ছিলো না।
* রাজউক ও পরিবেশগত ছাড়পত্র নিয়েছে কিনা সেটাও নিশ্চিত না। তাই আপাতত দৃষ্টিতে ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
এ ঘটনায় অবহেলার অভিযোগ মামলা করেছে পুলিশ। মামলায় কারখানার মালিক মো. আবুল হাসেমসহ তার চার ছেলে ও ডিজিএম, এজিএম ও প্রকৌশলীসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালত তাদের চার দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছেন। এই হচ্ছে অদ্য সংগঠিত ঢাকা নারায়ণগঞ্জে আগুন দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র।
টেলিভিশনে দেখলাম ভয়াবহ এই দুর্ঘটনা নিয়ে একজন কথা বলতে গিয়ে গুরুত্বারোপ করে বলছেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্ট শোক বার্তা পাঠিয়েছেন। পুড়ে ছাই হওয়ার পরে আমরা আর কত শোকবার্তা দেব? এই ধরনের অনভিপ্রেত মৃত্যুতে আমাদের যেন আর শোক বার্তা দিতে না হয় এই জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট যথাযথ কর্তৃপক্ষ কী ভাবছেন? যাদের পরিবারের সদস্য পুড়ে ছাই হয়েছেন তারা বাকরুদ্ধ, তাদের আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়েছে। শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক বার্তা দিয়ে আগুনে পুড়ে ছাই হওয়ার শোক সহিবার নহে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার জীবন অসীম সাহস ও বীরত্বে গাঁথা। রূপগঞ্জের কর্ণগোপ এলাকার হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ কারখানার সংগঠিত দুর্ঘটনার সঙ্গে সম্ভাব্য সংশ্লিষ্ট যে সমস্ত আলামত প্রকাশ হয়েছে তা অনভিপ্রেত। এ ব্যাপারে আপনার সঠিক দিকনির্দেশনা আমরা আশা করছি।
বেশিরভাগ মানুষই মনে করে আগুন দিয়ে আমরা মুরগির মাংস, গরুর মাংস রান্না করে খাই। সিগারেটে আগুন ধরিয়ে সুখ টান দেওয়া, অতঃপর জানালা দিয়ে সিগারেটের শেষের অংশ আগুনসহ ফেলে দেওয়া। আগুন নিয়ে আমরা খেলি কিন্তু আগুন কী জিনিস তা উপলব্ধি করতে পারি না। আসলেই আগুন কী? আগুন হলো- সাধারণত বাতাসের অক্সিজেনের সঙ্গে জ্বালানির কার্বন ও হাইড্রোজেনের মিলনে সৃষ্ট এক বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়া। আলোর মাধ্যমে এ রাসায়নিক বিক্রিয়া শক্তিতে প্রকাশ পায়।
আগুন ও এর ভয়াবহতা নিয়ে বছর পূর্বে একটি সচেতনতামূলক আর্টিকেল লিখেছিলাম। নারায়ণগঞ্জে আগুন দুর্ঘটনার ভয়াবহ চিত্র দেখে আবারো এর পুনরাবৃত্তি করতে মন চাচ্ছে। তাই অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত পরিসরে আলোচনার চেষ্টা করছি, যা হয়ত সামান্যতম সামাজিক সচেতনতা তৈরিতে সহায়ক হবে।
কেমন করে আমাদের অজান্তে আগুনের ধ্বংস লীলাখেলা সৃষ্ট হয়। ইহা সরকারের যথাযথ মন্ত্রণালয় যথাযথ কর্তৃপক্ষ জানেন। উদাসীনতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, অবহেলা, অবজ্ঞা, ছোট ছোট স্বার্থসংশ্লিষ্ট তার সঙ্গে আপোষহীন মনোভাব তৈরি করতে না পারাই আগুন দ্বারা সৃষ্ট দুর্ঘটনা বাংলাদেশে র্যান্ডমলি ঘটছে।
গ্যাস লাইনে লিক বয়সের ভারে নাজেহাল পুরানো ইলেকট্রিক মিটার, ফায়ার এক্সিট ছাড়া অপরিকল্পিত আবাসন, আমাদের উদাসীনতা আগুনের সূত্রপাত। গ্যাস শহুরে জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। রান্না থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল উন্নতির কথা গ্যাস ছাড়া চিন্তা করা যায় না। গ্যাস সরবরাহের জন্য সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পাইপ লাইন। পাইপ লাইনে লিক হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনাসহ সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি ঘটতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, প্রতিটি দুর্ঘটনা ঘটার পর আমরা মাতায় হাত দিয়ে বলি, ‘হায় রে, বাপ রে!’ তাই জানমাল ও ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে গ্যাস পাইপ লিক ও এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াটা জরুরি।
গ্যাস পাইপ লিক হলে বোঝার একমাত্র উপায় হলো গ্যাসের গন্ধ। গ্যাস পাইপের যে জাগায় লিক হলো তার আশেপাশে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে যাবে। গন্ধ পেলে বুঝতে হবে গ্যাস পাইপ লিক হয়েছে। গ্যাস পাইপ লিক হলে প্রথমে যে জায়গাটায় লিক হয়েছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। খুঁজে পাওয়ার পরে সেখানে স্কচটেপ লাগিয়ে স্থানীয় গ্যাস সেবা প্রদানকারী সংস্থাকে খবর দিতে হবে। পাশাপাশি সতর্ক থাকতে হবে গ্যাস পাইপ লিক হওয়া স্থানের আশে পাশে যাতে কেউ আগুন না জ্বালে বা দাহ্য জাতীয় পদার্থ আশেপাশে না রাখে -বিশেষ করে শুকনো কাঠ, পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ ইত্যাদি। দাহ্য জাতীয় পদার্থ আশেপাশে থাকলে তা সরিয়ে ফেলতে হবে। গ্যাস লাইনে কোনও ত্রুটি বা জরুরি অবস্থার জন্য গ্যাস কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে। প্রতিটি বাড়িতে, প্রতিটি মোবাইলে গ্যাস কোম্পানির যোগাযোগ নাম্বার সংরক্ষণ করে রাখা প্রতিটি সচেতন নাগরিকের নাগরিক দায়িত্ব।
পাঠক, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আগুন দ্বারা সৃষ্ট দুর্ঘটনার সঙ্গে গত ১৯ বছর ধরে আমি পেশাদারভাবে পরিচিত। অর্থাৎ ঐ বিষয়টি আমার কাজের অংশ। প্রতি দিনই কর্তব্যরত আমাকে লন্ডন ফায়ার বিগ্রেড (LFB) এর অফিসারদের সঙ্গে কাজ করতে হয়, যখন কোনো আগুনের দুর্ঘটনার আলামত আমার কর্ম পরিমণ্ডলে সৃষ্ট হয়। আমাকে তৈরি থাকতে হয় তা মোকাবিলা করার জন্য। লন্ডনে আমি যে হাসপাতালে কাজ করি সেখানে প্রতি সপ্তাহে সৃষ্ট হয় দুই একটা ফায়ার ইন্সিডেন্ট। আমাদেরকে সমানই act করতে হয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত লন্ডন ফায়ার ব্রিগেড অফিসার দ্বারা নিশ্চিত এটি সত্য বা মিথ্যা ফায়ার এলার্ম।
ফায়ার এলার্ম কী? আগুনের সংশ্লিষ্টতা স্মোক ডিটেক্টর নিশ্চিত করে প্রদান ফায়ার ট্রেনের সিগন্যাল পাঠায়। উদাহরণস্বরূপ বলি, আমার হাসপাতাল বিল্ডিং-এ কোনও এক জায়গায় ফায়ার এলার্ম শুরু হয়েছে। সিগন্যাল সরাসরি চলে যায় প্রধান ফায়ার প্যানেলে। সেখান থেকে bleeping সিস্টেমের মাধ্যমে ইন্সিডেন্ট অফিসার হিসেবে চলে আসে আমাদের কাছে। এরপর মেইন রিসেপশন জানিয়ে দেয় লন্ডন ফায়ার ব্রিগেডকে। ৫ থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে লন্ডন ফায়ার বিগ্রেড চলে আসে দুর্ঘটনা স্থানে। ফায়ার বিগ্রেড চলে আসার পূর্বেই আমাদেরকে identify করতে হয় আগুনের অবস্থান। নিশ্চিত করতে হয় রোগী ছাড়া সকল কর্মী বিল্ডিং থেকে বের হয়ে একটি নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান। তদেরকে বাইরে অবস্থান করতে হবে ফায়ার অফিসার দ্বারা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত। যতক্ষণ না ফায়ার অফিসার বলছেন ফিল্ডিং নিরাপদের পূর্বে কেউ বিল্ডিং-এ প্রবেশ করতে পারবেন না। প্রতি বছরই আমাকে ট্রেনিং করতে হয় আগুনের দুর্ঘটনার সর্বশেষ আপডেট বা রিফ্রেশমেন্ট নিয়ে।
আপনাদের একটু ধারণা দিলাম, লন্ডনে ফায়ার ইন্সিডেন্ট হলে সাধারণত কী হয়, কী করতে হয়। লন্ডন ফায়ার বিগ্রেড অফিসার্স তা পরিচালনা করেন।
পাঠক, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্ন। লন্ডনের সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করা ঠিক হবে না। কিন্তু অ্যাকশন একি হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক বাংলাদেশে। আমাদের মনে রাখতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত আগুন আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে ততক্ষণ তা আমাদের বন্ধু। আবার একটু অবহেলার কারণে তা আবার শত্রু হতে বিন্দুমাত্র দেরি করে না। সতর্কতার অভাবে মুহূর্তেই অগ্নিকাণ্ড ভস্মীভূত করতে পারে আপনার প্রিয় সাজানো সংসার বসতবাড়ি অফিস কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠাকে। তাই আপনাকে অবশ্যই তিনটি প্রধান বিষয় মাথায় রাখতে হবে-
প্রথমত: অগ্নিকাণ্ডের কারণ।
দ্বিতীয়ত: এ থেকে সতর্ক থাকার নিয়ম কানুন।
তৃতীয়ত: অগ্নিকাণ্ডের পর করণীয়।
লেখক: জার্নালিস্ট, ওয়ার্কিং ফর ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (NHS) লন্ডন। মেম্বার, দ্য ন্যাশনাল অটিস্টিক সোসাইটি ইউনাইটেড কিংডম।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন