।। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া।।
বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ইতিহাসে এক আপোষহীন ধ্রুবতারা নাম আনোয়ার জাহিদ। আনোয়ার জাহিদ ছিলেন সব্যসাচী রাজনীতিবিদ। নীতিহীন রাজনীতির যুগে তিনি সততা ও মেধাভিত্তিক রাজনীতির এক উজ্জল নক্ষত্র। যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্য আনোয়ার জাহিদ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন তারা তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী শক্তির মাঝে অকল্পনীয় যে ঐক্যের সূচনা হয়েছিল তার রুপকার ছিলেন তিনি। দু:খজনক হলেও সত্য সেই রুপকারকেই এক সময় ছিটকে ফেলে দিতে কুন্ঠিত হয়নি তারা। তার গড়ে দেয়া ঐক্য ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত দেশের রাষ্ট্র ক্ষমা পরিচালনা করলেও একবারও তাকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারে নাই। এমনকি তার চিকিৎসার জন্যও পাশে দাড়ায়নি তারা।
আনোয়ার জাহিদের মত মেধাবী ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের ছিটকে ফেলে দেয়ার মাশুল আজও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে দিতে হচ্ছে। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে। যার ফল আজও আমাদের ও জাতীয়তাবাদী শক্তিকে ভোগ করতে হচ্ছে। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ও জাতীয় নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়া পরবর্তী জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বার্থক নেতৃত্ব আনোয়ার জাহিদ। যখন রাজনীতিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে আঙ্গুল উঠানো হয় তখন আনোয়ার জাহিদকে উপস্থিত করা যায় সততা দৃষ্টান্ত হিসাবে।
রাজনীতিক জীবনে আনোয়ার জাহিদ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কঠোর সমালোচনা করলেও কারো সর্ম্পকে কুটুক্তি বা অশ্লিষ শব্ধ ব্যাবহার করতেন না। যা আজকের রাজনীতিতেই ক্রমেই কমে হ্রাস পাচ্ছে। তিনি সারাটা জীবন জাতীয় ঐক্যের রাজনীতি করেছেন। তার প্রদর্শিত পথে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জাতীয়তাবাদী শক্তি ক্ষমতা ভোগ করেছে। দুঃখ জনক হলেও সত্য যে, আনোয়ার জাহিদ প্রতিষ্ঠিত ঐক্যের শাসমালেও তিনি অবহলার ও অপমানের শিকার হয়েছেন।
আনোয়ার জাহিদ কখনো তার রাজনীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তিনি যে রাজনীতি বিশ্বাস করতে তাই প্রয়োগ করার চেষ্টা করতেন। আমরা যখন শুধুমাত্র ক্ষমতায় জন্য রাজনৈতিক বিশ্বাসকে পদদলীত করতে কুন্ঠিত হই না, তখন আনোয়ার জাহিদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় রাজনীতির সঙ্গা কি?
আনোয়ার জাহিদ ১২ জুন ১৯৩৮ সালে ঝিনাইদহের ঘোড়াশাল ইউনিয়নের নারিকেল বাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা এ এম দেলোয়ার হোসেন ও মাতা রাজিয়া বেগম। তিনি ১৯৫৬ সালে ঝিনাইদহ মডেল হাইস্কুল হতে প্রবেশিকা পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তিনি খুলনা বিএল কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন। ১৯৬১ সালে তিনি কারাগারে আইনজীবী কামরুননাহার লাইলীকে বিয়ে করেন। তাদের এক পুত্র ও এক কন্যা।
আনোয়ার জাহিদ ৫৫ সালে সাহিত্য মজলিসের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে দৈনিক ইত্তেহাদের সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৮ সালে অর্ধ সাপ্তাহিক ধূমকেতুর সহকারী সম্পাদক, ১৯৫৯ সালে দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক, ১৯৬০ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক, ১৯৬৩ সালে সাপ্তাহিক জনতার সম্পাদক, ১৯৬৬ সালে ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডের উপসম্পাদক, ১৯৭০ সালে সাপ্তাহিক গণবাংলা পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক, ১৯৭২ সালে ইংরেজি দৈনিক ডেইলি পিপলসের বার্তাসম্পাদক ও বাংলাদেশ টাইমসের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন। সর্বশেষ তিনি দৈনিক ইনকিলাবের উপদেষ্টা সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৬২, ৬৩, ৬৪, সালে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজ) সাধারণ সম্পাদক, ১৯৬৫ ও ৬৬ সালে সহসভাপতি, ১৯৭৮ ও ৮৩ সালে সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৬ ছাত্রলীগের ঝিনাইদহ মহকুমার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ঝিনাইদহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। ১৯৫৬ সালে রাজশাহী সরকারী কলেজের ছাত্রসংসদের জি এস নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। ১৯৬১ সালে গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৬২ সালে কারামুক্ত হন। ১৯৬৫ সালে নিখিল-পাকিস্তান ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে তিনি ভূমিকা রাখেন। ১৯৭৬ সালে ন্যাপ দুই ভাগে বিভক্ত হলে তিনি মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপের যুগ্নসম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে ন্যাপ পূনর্গঠিত হলে তিনি কেন্দ্রীয় সদস্য হন।
১৯৭৮ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়উর রহমানের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন ও ঘোষণাপত্র তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। একই সাথে তিনি ন্যাপের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। পরে গণতন্ত্রী পার্টি গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন এরশাদ সরকারের তথ্য, ত্রাণ এবং শ্রম-জনশক্তি মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জানুয়ারি ১৯৮৮ সালে মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন।
১৯৮৯ সালে তিনি এনডিপি এবং ১৯৯১ সালে বিএনডিপি গঠন করে দলের চেয়ারম্যানের দায়ীত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালের ১০ দলের সমন্বয়ে গঠিত এনডিএ'র সিক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে বিএনপিতে যোগ দেন এবং ২০০১ সাল পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপার্সনেরর তথ্য উপদেষ্টা ছিলেন।
আনোয়ার জাহিদ ১৩ আগস্ট ২০০৮ সালে ঢাকার গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
আনোয়ার জাহিদ আজীবন সাম্রাজ্যবাদী, আধিপত্যবাদীদের বিরুদ্ধে ও মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য কাজ করে গেছেন। তার মতো মেধাবী ও প্রজ্ঞাবান নেতার প্রয়োজন জাতি সব সময় অনুভব করবে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করি। তিনি বেঁচে থাকলে গণতন্ত্রকামী মানুষ উপকৃত হতেন। তার শুন্যতা পুরণ হওয়ার নয়। ক্রান্তিকালে তিনি জাতীয়তবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধের শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। আনোয়ার জাহিদ বলতেন দেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা বিদ্যমান। একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধের শক্তি, অন্যটি আধিপত্যবাদীদের দোসর। তার এই বিশ্বাস জাতি গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারছে।
আজকের জাতীয়তাবাদী শক্তির যে দুর্দিন চলছে তাও বোধ করি অতিতের ভুলেরই খেসারত। দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকলেও কি আমরা আমাদের জাতীয় বীরদের যথাযথ সম্মান করতে পেরেছি ? না পারলে কেন পারি নাই ? এখানো কেন পারছি না ? তাহলে কি করে আমাদের সামনে চেতনার বাতিঘরগুলো জ্বলে উঠবে। আর চেতনার বাতিঘরগুলোকে যদি আমরা অবহেলায় অনাদরে প্রজন্মের কাছ থেকে আড়াল করে ফেলি তাহলে কি করে মুক্তি আসবে আমাদের ?
সততার এক রাজনীতির এক উজ্জল রাজনীতিক নেতা জননেতা আনোয়ার জাহিদের ১৩তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীরতম শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতে চাই আমাদের মুক্তির রাস্তার আলো খুজে বের করতেই আমাদের স্মরণ করতে হবে মত জাতীয় বীরদের। অন্যথায় সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরো বেশী দুর্দিন।
(লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট,
মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন)
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন