মিজানুর রহমান মিজান
২১শে আগষ্ট ২০২১ সাল।ফজরের নামাজ আদায় করে শেষ হতেই কানে বাজলো মসজিদের মাইকে একটি ঘোষণা।মৃত্যু সংবাদ।শুনে চমকে উঠলাম নামটি শুনে।চলে গেলাম স্মৃতির পশরায়।আজ থেকে আট নয় বৎসর পূর্বে আমার এক নিকটাত্মীয় দরিদ্র লোক ভীষণ রোগাক্রান্ত।আমাকে কেন জানি ডাকলেন তিনি ডাক্তারের নিকট যাবেন। আমি সঙ্গে যেতে।হয়তো বা আস্তা,নির্ভরশীলতা ও বিশ্বাসের মুল্যায়ন থাকতে পারে।আর তা ভেবেই অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও যেতে সম্মত হলাম। অনেক দিন যাবত তিনি শহরের নামকরা একজন ডাক্তারের অধীন চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন।ডাক্তার সাহেব রোগীর সে সময়ের অবস্থান জেনে বললেন ঐদিন, রোগীর ফুসফুসে পানি জমে গেছে।চারটি পরিক্ষার কথাও লিখে দিলেন এবং তাড়াতাড়ি অপারেশন প্রয়োজন।ষাট হাজার টাকা লাগবে এবং তিনির নির্দেশিত হাসপাতালে ভর্তির আদেশ্।রোগীর জন্য আমার সাধ্যমত অনুরোধ জানালাম কিছু কমতির নিমিত্তে বা রোগির সামর্থ নেই এ পরিমাণ টাকা সংগ্রহের। কিন্তু তিনির নিকট অনুরোধ বা রোগির আকুতি নিষ্ফল।একই কথা।এদিকে রোগির কথা হল, তিনি এতো টাকা দেয়া সম্ভব নয় কোনক্রমেই।মরণ হলেও।কি করা, ভেবে পাচ্ছি না।রোগিই আমাকে জানালেন এলাকারই অতি পরিচিত একজন ডাক্তারের কথা।সেখানে যাবার সিদ্ধান্তের কথা আমাকে জানালেন এবং যেতে তিনি বদ্ধপরিকর।সময় হাতে আছে এবং তিনিকে পাবার সম্ভাবনা থাকায় ঐ স্থান ত্যাগ করে চলে গেলাম চেম্বারে।পেয়েও গেলাম তিনিকে।কিন্তু তিনি তখন ছিলেন অসুস্থ।তিনি রোগির রোগ সম্পর্কে জেনে জনাব আবু সলমান চৌধুরীকে বলতেন লিখার জন্য এবং সলমান সাহেব লিখতেন ও ঔষধ দিতেন।তিনি রোগিকে দেখেই অত্যন্ত স্বজ্জনের পরিচিতি পেলাম রোগির সহিত কোশল বিনিময়ের কালে।ডাক্তার সাহেব আমাকে শুধালেন, আমি রোগির কি হই?সম্পর্কটুকু বলা মাত্রই তিনি বললেন, ঐ রোগির কোন রোগ নেই। তিনি আমার কথা, নিয়ম নীতি পালন করেন না বিধায় হয়েছেন রোগি।সুতরাং আপনি যদি রোগিকে শুধু মাত্র ঠান্ডা পানি এবং শীত বস্ত্র পরিধান করিয়ে রাখতে পারেন। রোগি ভাল হয়ে যাবে।আমি অবশ্যই সেক্ষেত্রে তিনির নির্দেশিত নির্দেশ পালনের নিশ্চয়তা প্রদান করায় তিনি অত্যন্ত স্বল্প এবং নরমাল দুটি ট্যাবলেটের নাম লিখে দিয়ে আসার কথা বললেন।ফি টুকু দিতে চাইলে রোগির এক টাকাও রাখেননি।ডাক্তার সাহেব যে আমার এলাকার তা আগে আমি জানতাম।যাক রোগিকে নিয়ে এলাম প্রেসক্রাইব করা ঔষধ কিনে।তবে আমার ধারণা ছিল ঐ ঔষধগুলি সম্ভবত রোগিকে শান্তনার নিমিত্তে লিখা।
আমি দেখেছি ডাক্তার সাহেবের নির্দেশিত ঔষধ ও নির্দেশ পালনে রোগি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যেতে।প্রয়োজন হয়নি পরিক্ষার, লাগেনি বিভিন্ন প্রকার টেস্ট।অপারেশনতো দুরের কথা।রোগির পূর্বের ডাক্তারের নির্দেশে শুধু বিভিন্ন টেস্টেই নাকি সাত হাজার টাকা খতম হয়েছিল।পরে রোগি আমাকে বলেছিলেন।যদিও আমি এলাকার ডাক্তার সাহেবের নামের সাথে পরিচিত ছিলাম। কিন্তু স্বচক্ষে কখনও দেখা হয়নি। ঐদিনই তিনির সহিত আমার স্বশরীরে সাক্ষাৎ ও আলাপচারিতা।অত:পর আমার বয়োবৃদ্ধ মাকে নিয়ে তিনির কাছে গিয়েছি চিকিৎসার্থে তিন থেকে চারবার।আমি ফলাফল পেয়েছি অত্যন্ত সুন্দর ও সফলতার সহিত।আজো আমার মা বেঁচে আছেন পৃথিবীতে।তিনির কাছে গেলে কোন প্রকার টেস্টের সম্মুখীন হইনি, হতে হয়নি।কিন্তু দূর্ভাগ্যই বলতে হয় কয়েক বৎসর পর আমি যোগাযোগ করি আবু সলমান সাহেবের সহিত।প্রত্যুত্তরে তিনি জানালেন ডাক্তার সাহেব এখন আর রোগি দেখেন না।তখন ভীষণ ব্যথিত হয়েছিলাম।
আমি এক সময় দীর্ঘ দিন সৌদী আরব প্রবাসী ছিলাম।একবার মারাত্মক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়লাম।অনুসন্ধান চালালাম বাঙ্গালী কোন ডাক্তার আছেন কি না? এক সময় পেয়ে গেলাম অনুসন্ধানে একজনকে।তিনির নাম হচ্ছে ডাক্তার তাজ উদ্দিন সাহেব।নাম শুনে চলে গেলাম তিনির বাসভবনে এবং পেয়েও গেলাম তিনিকে।রোগের আদ্যপান্ত শুনে তিনি আমাকে অতি অল্প ঔষধ লিখে মৌখিক পরামর্শ প্রদান করলেন।চিকিৎসা প্রদান শেষে আমার পরিচয় জানতে চাইলে সিলেটের বিশ্বনাথে বাড়ি শুনে জিজ্ঞাসা শুরু করলেন আমারই আশে পাশের বিভিন্ন শিক্ষিতজনদের কথা। আমি চিনি কি না?যাঁদের কথা বলছিলেন, আমি সবাইকে চিনি জানি।তখন তিনির বাড়ির কথা জিজ্ঞাসায় জানতে পারি, তিনি হচ্ছেন বিশ্বনাথেরই কৃতি সন্তান।জেদ্দার নামকরা হাসপাতালে সরকারি চাকুরীরত এবং পরিবার পরিজন নিয়ে সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বাসায় থাকেন।তিনির নিকট থেকে অবগত হলাম, পরিচয় পেলাম আমার আজকের লেখার উদ্দিষ্ট ব্যক্তিত্ব জনাব ডা: আবুল লেইছ সাহেবের কথা।আরো জানলাম টাঙ্গাইলের মরহুম ডা:মতিউর রহমানের কথা।ডা: আবুল লেইছ সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করা হয়নি অন্য শহরে বসবাসের কারনে।ঐদিনই তিনির বাসায় রোগির সাথে যাবার সুবাদে সরাসরি হয়ে যায় দেখা।তবে অল্পক্ষণের আলাপে হয়েছিলাম অভিভুত।
আমি ১৯৭৭ সালে মদন মোহন কলেজে ভর্তি হই।তখনকার সময়ে যে সকল নামকরা ডাক্তার সিলেটে ছিলেন তাঁরা হচ্ছেন ডা: আব্দুল খালিক,ডা:আমিনুর রহমান, ডা: আব্দুর রকিব প্রমুখ।এ সকল ডাক্তারদের জন্য রোগি ছিলেন পাগলপারা এবং তাদের আত্মীয়-স্বজনেরা।দেখেছি, শুনেছি এ সকল ডাক্তাররা রোগিকে অল্প ঔষধ লিখতেন।ভাল ফলাফলও পেতেন।তখন প্রাইভেট এতো ক্লিনিক, রোগ নির্ণয় কেন্দ্র বা প্যাথোলজিক্যাল সেন্টার ছিল না।চিকিৎসকরা ও হরেক রকম টেস্টের পরামর্শ দিতেন না।প্রয়োজন হলে বড়জোর মল মুত্র কিংবা এক্সরের পরামর্শ দিতেন।
আমি এতক্ষণ যার কথা বলছিলাম তিনির পরিচয় দেয়া একান্ত আবশ্যক মনে করছি। তাই এখানে তিনির পরিচয়টুকু তুলে ধরতে বাধ্য হলাম। আমার এলাকার আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যার পরিচিতি রয়েছে, তিনি হচ্ছেন খাজাঞ্চী ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ইসলামাবাদ গ্রামের সুপরিচিত, গরিবের বন্ধু কৃতি সন্তান, যিনি আমাদের এলাকার গৌরব ডাক্তার আবুল লেইছ সাহেব।খাজাঞ্চী ইউনিয়নের মরহুম মাওলানা আব্বাস আলী (র:)ইসলামাবাদী ও শায়খে আব্দুল করিম(র:)কৌড়িয়ার অধ:স্তন বংশধর একজন সুচিকিৎসক ও ব্যক্তিত্বশালী একজন সুপুরুষ।তিনি অত্যন্ত ভদ্র, নম্র, মিষ্টবাসী, পরোপকারী, দেশ প্রেমিক, সমাজ সেবক ছিলেন।তিনির শুন্যতা পরিপূর্ণ হবার নয় সহজে খাজাঞ্চী বাসীর জন্য।আমরা হারিয়েছি তিনিকে। চলে গেছেন না ফেরার দেশে।মহান রাব্বুল আলামিন তিনিকে জান্নাতবাসী করুন এ আমার নিরন্তর প্রার্থনা।
লেখক মিজানুর রহমান মিজান, প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক চাঁন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার, রাজাগঞ্জ বাজার, বিশ্বনাথ, সিলেট।
মন্তব্যসমূহ (০) কমেন্ট করতে ক্লিক করুন